বায়ুমন্ডলের তাপ ও তাপের তারতম্যের কারণ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 08/08/2012 - 19:57

বায়ুমন্ডলের তাপ ও তাপের তারতম্যের কারণ:-

বায়ুর উষ্ণতার তারতম্যের কারণ (Major factors influencing Air Temperature) :- সূর্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার প্রধান উৎস । সূর্যরশ্মির তাপীয় ফলের মাধ্যমে বা ইনসোলেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল কয়েকটি পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে । এই পদ্ধতিগুলি হল— (i) বিকিরণ পদ্ধতি, (ii) পরিবহন পদ্ধতি, (iii) পরিচলন পদ্ধতি, (iv) অ্যাডভেকশন এবং (v) তাপ শোষণ ।

(i) বিকিরণ পদ্ধতি (Radiation) : যে পদ্ধতিতে কোনো মাধ্যম ছাড়াই বা মাধ্যম থাকলেও তাকে উত্তপ্ত না করে তাপ এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে চলে যায়, সেই পদ্ধতিকে বিকিরণ পদ্ধতি বলে । বায়ুমণ্ডল সূর্যকিরণের দ্বারা সরাসরিভাবে উত্তপ্ত হয় না । সুর্য থেকে আলোর তরঙ্গ বায়ুমণ্ডল ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে । সূর্য থেকে আগত বিকিরিত তাপশক্তি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়লেও বায়ুমণ্ডলকে প্রথমে উত্তপ্ত না করে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে । ভূপৃষ্ঠ সেই তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে । ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আলোক চৌম্বকীয় তরঙ্গরূপে সেই তাপের বিকিরণ শুরু হয় ও ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ।

(ii) পরিবহন পদ্ধতি (Conduction) : যে পদ্ধতিতে কোনো পদার্থের উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে তাপ সঞ্চালিত হয় কিন্তু পদার্থের অণুগুলি স্থান পরিবর্তন করে না, সেই পদ্ধতিকে পরিবহন পদ্ধতি বলে । সূর্য থেকে বিকিরণ পদ্ধতিতে আগত তাপশক্তি বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে এলেও বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত না করে প্রথমে কঠিন ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে । ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে লেগে থাকার ফলে পরিবহন পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় । ক্রমে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন উত্তপ্ত বায়ুস্তর থেকে উত্তাপ ওপরের অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ুস্তরে পরিবাহিত হয় । এইভাবে বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় ।

(iii) পরিচলন পদ্ধতি (Convection) : ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন বায়ুস্তর অধিক উত্তপ্ত হওয়ার ফলে বায়ু প্রসারিত ও হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় । তখন সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ওপরের অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু নীচে নেমে আসে । তারপর ওই বায়ুও আবার ক্রমে উষ্ণ ও হালকা হয়ে পুনরায় ওপরে উঠে যায় । এইভাবে নীচ থেকে উপরে ও উপর থেকে নীচে বায়ু চলাচলের ফলে উলম্বভাবে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ও বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয় । বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার এই পদ্ধতিকে পরিচালন প্রক্রিয়া বলে ।

(iv) অ্যাডভেকশন (Advection) : এক জায়গার উত্তাপ বায়ুর মাধ্যমে যখন ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে অনুভূমিকভাবে বা সমান্তরালে অন্য জায়গায় চলে যায়, তাকে অ্যাডভেকশন বলে । অ্যাডভেকশন পদ্ধতিতে অনেক সময় শীতল বায়ু ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে উষ্ণ বায়ুর দিকে প্রবাহিত হয়ে তাপ সঞ্চালনের মাধ্যমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে । যেমন — নিম্ন অক্ষাংশের বেশি উষ্ণতা বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে উচ্চ অক্ষাংশের বায়ুমণ্ডলে স্থানান্তরিত হয় ।

 
 

(v) তাপ শোষণ (Heat Absorbtion) : সূর্যরশ্মি যখন যখন বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে আসে তখন তার কিছু অংশ বায়ুমণ্ডলে অবস্থানকারী কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ অন্যান্য গ্যাস, জলীয় বাষ্প, ধূলিকণা প্রভৃতি আগত সূর্যরশ্মি থেকে তাপ শোষণ করে বায়ুমণ্ডলকে সামান্য উত্তপ্ত করে তোলে ।

বায়ুর উষ্ণতার তারতম্যের কারণ :- ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র তাপ সমান নয় । স্থানভেদে বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য ঘটে ।  বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য ঘটে বিভিন্ন কারণে, যথা— (i) অক্ষাংশ, (ii) সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা, (iii) সমুদ্র থেকে দুরত্ব, (iv) বায়ুপ্রভাব, (v) সমুদ্রস্রোত, (vi) ভূমির ঢাল, (vii) ভূমির প্রকৃতি, (viii) অরণ্যের অবস্থান, প্রভৃতি ।

(i) অক্ষাংশ (Latitude) :- সুর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার প্রধান উৎস হলেও অক্ষাংশ অনুসারে সূর্যরশ্মির পতনকোণের পার্থক্য ঘটে । নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্যরশ্মি লম্বভাবে পড়লেও নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে যতই মেরু অঞ্চলের দিকে যাওয়া যায় সূর্যরশ্মি ততই তির্যকভাবে পতিত হতে থাকে । লম্বভাবে পতিত সূর্যরশ্মি স্বল্পস্থান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ও অনেক কম বায়ুস্তর ভেদ করে আসে বলে তির্যকরশ্মি তুলনায় লম্বরশ্মিতে উষ্ণতার পরিমাণ অধিক হয় । নিরক্ষরেখা থেকে যতই উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া যায় ততই সূর্যরশ্মি পৃথিবীপৃষ্ঠে তির্যক ভাবে পড়তে থাকে, ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে উভয় মেরুর দিকে উত্তাপ ক্রমশ কমতে থাকে । সাধারণত, নিরক্ষরেখা থেকে উত্তর বা দক্ষিণে প্রতি ১ অক্ষাংশের তফাতে ০.২৮ সেলসিয়াস হারে উষ্ণতা হ্রাস পায় । নিরক্ষরেখার উভয় দিকে ২৩½ অক্ষাংশ পর্যন্ত স্থান গ্রীষ্মমণ্ডল বা উষ্ণমণ্ডলের অন্তরর্গত । সারা বছর ধরে এই অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উষ্ণ থাকে । নিরক্ষরেখার উত্তর ও দক্ষিণে ২৩½ থেকে ৬৬½ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের অন্তরর্গত । এই অঞ্চল গ্রীষ্মে খুব একটা উষ্ণ বা শীতে খুব একটা শীতল হয় না । দুই মেরুর চতুর্দিকে ৬৬½ থেকে ৯০ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল হিমমণ্ডলের অন্তরর্গত । এই অঞ্চলে সূর্যরশ্মি সবচেয়ে তির্যকভাবে পড়ে । এই সমস্ত কারণে এই অঞ্চল দুটি অত্যন্ত শীতল ।

কলকাতা শহরটি ২২°৩০' উত্তর অক্ষাংশে এবং লন্ডন শহরটি ৫১° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত হওয়ায় কলকাতা শহরটি তুলনায় নিরক্ষরেখার কাছে অবস্থিত । এজন্য কলকাতার উষ্ণতা লন্ডনের চেয়ে অনেক বেশি হয় ।

(ii) সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা:- উচ্চতা বায়ুমন্ডলের তাপের একটি প্রধান নিয়ন্ত্রক । নিম্ন বায়ুমণ্ডলে ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা প্রতি ১ কিমিতে সাধারণত ৬.৪° সে. হারে হ্রাস পায় । একে উষ্ণতা হ্রাসের স্বাভাবিক হার বা নরম্যাল ল্যাপস রেট বলে । তাই একই অক্ষাংশে অবস্থান করলেও সমভূমি অপেক্ষা পার্বত্যভূমির উষ্ণতা অনেক কম হয়ে থাকে । শিলিগুড়ি ২৬°৪৩' উত্তর অক্ষাংশে ও দার্জিলিং ২৭°১৩' উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত । শহর দুটি প্রায় একই অক্ষাংশে অবস্থান করলেও অধিক উচ্চতার কারণে শিলিগুড়ি অপেক্ষা দার্জিলিং -এর উষ্ণতা প্রায় ১২° সে. কম হয় ।

ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা কমে যাওয়ার কারণ হল :-

(ক) উপরের বায়ুস্তরে ধূলিকণা কম থাকায়, ঐ বায়ূস্তরের তাপ গ্রহণ ও সংরক্ষণ করার ক্ষমতা কম হয়;

(খ) উপরের বায়ুস্তর অপেক্ষাকৃত হালকা বলে, ঐ স্তরের বায়ু সহজেই তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়;

(গ) সূর্যকিরণ বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে আসে, কিন্তু বায়ুর সূর্যকিরণের উত্তাপ সোজাসুজি গ্রহণ করার ক্ষমতা খুব কমই । সূর্যের তাপ ভূপৃষ্ঠে পড়ে ভূপৃষ্ঠকে প্রথমে উত্তপ্ত করে, পরে সেই উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠ তাপ বিকিরণ করলে বায়ূমন্ডলের সবচেয়ে নীচের স্তর সেই বিকীর্ণ তাপ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ লাভ করে । এজন্য ঠিক ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তরের উপরের স্তরের বায়ু ক্রমশই কম উষ্ণতা লাভ করে বলে ওপরের বায়ুস্তরে উষ্ণতা কম হয়;

(ঘ) ভূপৃষ্ঠের উত্তপ্ত বাতাস হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায় এবং সেখানে হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় তা শীতল হয়ে পড়ে ।

উষ্ণতার বৈপরিত্য [Inversion of Temperature] :- সাধারণ নিয়ম অনুসারে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর উষ্ণতা কমতে থাকে । শীতের রাতে শান্ত আবহাওয়ায় পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চলে অনেক সময় উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতা হ্রাস না পেয়ে বরং বৃদ্ধি পায় । একে বৈপরীত্য উষ্ণতা বা উষ্ণতার উৎক্রম বলা হয় । পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চলে রাতের বেলায় শান্ত আবহাওয়ায় পর্বতের ওপরের অংশের বায়ু দ্রুত তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়লে তা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পর্বতের ঢাল বেয়ে উপত্যকার নীচে নেমে আসতে থাকে এবং পর্বতের নীচের অংশ বেশি ঠান্ডা হয় । একে ক্যাটাবেটিক বায়ু বলে । এই শীতল বায়ু উপত্যকার নীচের উষ্ণ বায়ুকে ঠেলে ঢাল বরাবর ওপরে তুলে দেয় । একে অ্যানাবেটিক বায়ু বলে । তখন উপত্যকার নীচ থেকে যত ওপরে ওঠা যায়, উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে । বৈপরীত্য উষ্ণতার কারণে উপত্যাকা অঞ্চলের কৃষিকাজ ব্যাহত হয় । এছাড়াও ভূপৃষ্ঠ বায়ুমন্ডলের তুলনায় দ্রুতহারে তাপ বিকিরণ করে বলে ভূপৃষ্ঠ এবং ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুও বেশি শীতল হয় । অন্যদিকে, বায়ুর পরিবহণ ক্ষমতা কম হওয়ায় উপরের স্তরের বায়ু সহজে শীতল হয় না । এই কারণে বৈপরীত্য উষ্ণতার সৃষ্টি হয় ।

কোনও শৈলাবাসে যেমন- দার্জিলিং গেলে বৈপরীত্য উত্তাপ ব্যাপারটা ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয় । ভোরবেলায় এখানে বৈপরীত্য উত্তাপের জন্য উপত্যকাগুলি মেঘে ঢাকা থাকে । বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ূর উষ্ণতা বাড়লে উপত্যকাগুলি মেঘমুক্ত হয় ।

(iii) সমুদ্র থেকে দুরত্ব:- সমুদ্র থেকে দূরত্বের জন্য বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য ঘটে ।

(ক) পৃথিবীর কোনো স্থান সমুদ্র থেকে যত দূরে অবস্থিত হয়, সেখানে উষ্ণতার ততই চরম ভাব দেখা যায়, কারণ, গ্রীষ্মকালে একই অক্ষাংশে অবস্থিত মহাদেশগুলি স্থলভাগের উপরিভাগ সমুদ্রের জলের চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয় । ফলে, সমুদ্র থেকে ঠান্ডা বায়ু মহাদেশগুলির দিকে প্রবাহিত হয়ে মহাদেশের উষ্ণতা হ্রাস করে ।

(খ) শীতকালে মহাদেশগুলির স্থলভাগের উপরিভাগ সমুদ্রের জলের চেয়ে বেশি শীতল হয়ে পড়ে এবং মহাদেশগুলি থেকে ঠান্ডা বাতাস সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয় । এই জন্য সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে আবহাওয়া কখনই চরমভাবাপন্ন হয় না, অর্থাৎ উষ্ণতার পরিমাণ কখনই খুব বেশি বা কম হয় না ।

(গ) সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত মহাদেশের ভিতরের দিকে সমুদ্রের প্রভাব ততটা পড়ে না বলে জলবায়ুতে চরমভাব দেখা যায়, অর্থাৎ ঠান্ডা ও গরম দুই-ই খুব বেশি হয় ।

(ঘ) জল ও স্থলের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য দিনের বেলা সমুদ্র থেকে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বাতাস স্থলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়, একে সমুদ্র বায়ু বলে । আবার রাত্রি বেলা স্থলভাগ থেকে ঠান্ডা বাতাস জলভাগের দিকে প্রবাহিত হয়, একে স্থলবায়ু বলে।

(iv) বায়ুপ্রভাব :- ভূপৃষ্ঠের কোনো অঞ্চলের ওপর দিয়ে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হলে সেখানকার বায়ুর তাপমাত্রা বেশি হয়  আবার কোনো অঞ্চলের ওপর দিয়ে শীতল বায়ু প্রবাহিত হলে সে অঞ্চলের বায়ুর তাপমাত্রা কম হয় । যেমন, গ্রীষ্মকালে উষ্ণ 'লু' বায়ুর প্রভাবে উত্তর ভারতে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, আবার শীতল সাইবেরীয় বায়ুর প্রভাবে চিনে শীতকালীন উষ্ণতা হ্রাস পায় ।

(v) সমুদ্রস্রোত :- বায়ুর তাপমাত্রার উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় ও শীতল স্রোতের প্রভাবে বায়ুর উষ্ণতা হ্রাস পায় । যেমন— উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলভাগ সারা বছর বরফমুক্ত থাকে । উষ্ণ উত্তর আটলান্টিক স্রোতের প্রভাবে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও পশ্চিম ইউরোপের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডার হাত থেকে ওখানকার দেশগুলি রক্ষা পেয়েছে । কিন্তু শীতল লাব্রাডার স্রোতের প্রভাবে লাব্রাডার উপকূল বরফে জমে থাকে এবং শীতল বেরিং স্রোতের প্রভাবে জাপানের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চল অধিক শীতল হয়ে ওঠে ।           

(vi) ভূমির ঢাল :- ভূমির ঢালের তারতম্যের জন্য বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য ঘটতে দেখা যায় । ভূমির সূর্যমুখী ঢালে সরাসরি সূর্যকিরণ পড়ার কারণে উষ্ণতা অনেক বেশি হয় । আবার এর বিপরীত ঢালে আলোর ছায়ায় উষ্ণতা তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে । যেমন, মেঘালয় মালভূমির দক্ষিণের সূর্যমুখী ঢাল অপেক্ষা উত্তর ঢালের উষ্ণতা অনেক কম হয় । উত্তর গোলার্ধে হিমালয়, আল্পস প্রভৃতি পর্বতের দক্ষিণদিক নিরক্ষরেখার দিকে ঢালু হওয়ায় তাপমাত্রা বেশি হয়, কিন্তু উত্তর দিক উত্তর মেরুর দিকে ঢালু হওয়ায় তাপমাত্রা খুব কম হয় ।            

(vii) ভূমির প্রকৃতি :- মৃত্তিকার প্রকারভেদে বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য ঘটে থাকে । কাদাযুক্ত পলি মৃত্তিকার তাপ ধারণ ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে পলি মৃত্তিকা সমৃদ্ধ অঞ্চলের উষ্ণতা অধিক হয় । আবার পাথুরে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার তাপ ধারণ ক্ষমতা কম বলে এই মৃত্তিকা দ্রুত উষ্ণ বা শীতল হয় । এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পলি মৃত্তিকা অঞ্চলের তুলনায় ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা সমৃদ্ধ বীরভূম জেলার উষ্ণতা চরম প্রকৃতির হয় । আবার মৃত্তিকার রং বায়ুর উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায় । হালকা রঙের মৃত্তিকার তুলনায় গাঢ় রঙের মৃত্তিকা অধিক তাপ শোষণ করে উষ্ণ হয়ে উঠে । 

(viii) অরণ্যের অবস্থান :- স্বাভাবিক উদ্ভিদের ঘন অরণ্যের মধ্যে সূর্যালোক সহজে প্রবেশ করতে পারে না বলে অরণ্যাঞ্চলের উষ্ণতা সাধারণত কম হয় । মাটি থেকে উদ্ভিদ যে রস শোষণ করে, সেই রস বাষ্পের আকারে পাতা দিয়ে বায়ুতে ছেড়ে দেয় । ফলে বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় । এই কারণে অরণ্যের বাতাস আর্দ্র হয় বলে সেখানকার উষ্ণতার হ্রাস বা বৃদ্ধি বিশেষ ঘটে না । এই কারণে ব্রাজিলের সেলভা অরণ্যাঞ্চলের উষ্ণতা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয় । আবার জলীয়বাষ্প বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে । বৃষ্টিপাতের ফলে বায়ুর তাপমাত্রা হ্রাস পায় । ফলে অরণ্যাঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে উষ্ণতা কম হয়ে থাকে । এই ভাবে স্বাভাবিক উদ্ভিদের অবস্থান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বায়ুর তাপমাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ।

*****

Related Items

নর্মদা নদী (The Narmada)

নর্মদা নদী (The Narmada) : মহাকাল পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অমরকন্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে নর্মদা নদী উত্তর-পশ্চিমে বেঁকে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরার সংকীর্ণ গিরিখাত অতিক্রম করে

ব্রহ্মপুত্র নদ (The Brahmaputra)

ব্রহ্মপুত্র নদ : তিব্বতের মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমায়ুং-দুং হিমবাহ থেকে সাংপো নামে উৎপন্ন হয়ে নামচাবারওয়া শৃঙ্গের কাছে চুলের কাটার মত বেঁকে অরুণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে ডিহং নামে ভারতে প্রবেশ করেছে । এর মোট দৈর্ঘ্য ২,৯০০ কিমি, এর মধ্

সিন্ধু নদ (The Indus)

সিন্ধু নদ : সিন্ধু নদ তিব্বতের মানস সরোবরের উত্তরে অবস্থিত সিন-কা-বাব জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রথমে তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে লাদাখ অঞ্চল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে । সিন্ধু নদের মোট দৈর্ঘ্য ৩,১৮০ কিমি এবং এর মধ

গঙ্গা নদী (The Ganges)

গঙ্গা নদী : গঙ্গা ভারতের শ্রেষ্ঠ নদী এবং ভারতের দীর্ঘতম নদী । গঙ্গানদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিমি এবং এর মধ্যে ২০১৭ কিমি ভারতে প্রবাহিত । কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষার গুহা থেকে ভাগীরথী নামে উৎপন্ন হয়ে সংকীর্ণ গিরিখাতের

ভারতের নদনদী (Rivers of India)

ভারতের নদনদী : ভারতে অসংখ্য নদনদী বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে । উৎস, প্রবাহের অঞ্চল, এবং মোহানা অনুসারে ভারতের নদনদীকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যেমন— (১) উত্তর ভারতের নদী এবং (২) দক্ষিণ ভারতের নদী ।