ভারতের খাদ্যশস্য — ধান

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 11/24/2014 - 20:12

ভারতের খাদ্যশস্য — ধান (Paddy) : ভারতের প্রধান খদ্যশস্য হল ধান । পৃথিবীর মোট ধান উৎপাদনের প্রায় শতকরা ২৩ ভাগ ধান ভারতে উৎপন্ন হয় । ধান উৎপাদনে ভারত বর্তমানে পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ও চিন প্রথম স্থান অধিকার করে ।

ধান উৎপাদনের অনুকুল পরিবেশ :

(১) বৃষ্টিপাত :  ধান চাষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় । ১০০ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত ধান চাষের পক্ষে আদর্শ । ধান গাছের বৃদ্ধি ঘটাতে গাছের গোড়ায় জল জমে থাকা দরকার । কিন্তু ধান কাটার সময় বৃষ্টি হলে ধান উৎপাদনে ক্ষতি হয় । এই সময় শুকনো জলবায়ুর প্রয়োজন । ধান চাষের সময় জমিতে সময় মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে জলসেচের ব্যবস্থা থাকলে তা ধান চাষের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক ।

(২) উত্তাপ : ধান চাষের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যের উত্তাপ প্রয়োজন ।  ১৬° থেকে ৩০° সেলসিয়াস উত্তাপ ধান চাষের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক ।

(৩) জমির প্রকৃতি :  গাছের গোড়ায় জমে থাকা জল ধান গাছের বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে, তাই নদী অববাহিকা বা বদ্বীপ অঞ্চলের নিচু সমতল জমি ধান চাষের পক্ষে আদর্শ । এছাড়া পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে সমতল ভুমি তৈরি করেও ধান চাষ করা হয় । বর্তমানে উন্নত কৃষি পদ্ধতি ও উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে প্রতিকুল অবস্থাতেও ধান চাষ করা হয় ।

(৪) মৃত্তিকা :  নদী উপত্যকা, বদ্বীপ এবং উপকুল অঞ্চলের নিম্ন সমভূমির পলিমাটি যুক্ত উর্বর দোআঁশ ও এঁটেল মাটি ধান চাষের পক্ষে আদর্শ । মাটিতে কাদার পরিমাণ কিছুটা বেশি থাকলে ধান চাষ ভাল হয় । কারণ এতে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায়, যা ধান গাছের গোড়ায় জল জমিয়ে রাখতে সাহায্য করে ।

(৫) সার ও কীটনাশক বিষ প্রয়োগ :  উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে গোবর, কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্ট প্রভৃতি জৈব সার এবং ইউরিয়া, সুপার ফসফেট, পটাশ প্রভৃতি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় । এছাড়া বোরন, দস্তা, প্রভৃতি অনুখাদ্য ধান চাষের জন্য প্রয়োজন হয় । কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে ধান গাছকে রক্ষা করতে রাসায়নিক কীটনাশক বিষ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় । এছাড়া ছত্রাকের আক্রমণ থেকে ধান গাছকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক ছত্রাকনাশক প্রয়োগ জরুরি হয় ।

(৬) সুলভ শ্রমিক : ধান চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি করতে ক্ষেতে লাঙল দেওয়া, বীজ ছড়ানো, রোপণ এবং ফসল কাটার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর পরিশ্রমী ও দক্ষ সুলভ শ্রমিকের প্রয়োজন হয় ।

(৭) মূলধন ও আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার : বর্তমানে একই জমিতে একাধিকবার ও বেশি পরিমাণে ধান উৎপাদন করার জন্য বেশি মূলধন বিনিয়োগ করে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় ।

ধান চাষ পদ্ধতি : ভারতে সাধারণত দু'রকম পদ্ধতিতে ধান চাষ হয়ে থাকে, যেমন— (১) রোপণ পদ্ধতি  এবং (২) বপন পদ্ধতি ।

(১) রোপণ পদ্ধতি : রোপণ পদ্ধতিতে অল্প খানিকটা জমিতে লাঙল দিয়ে ঘন করে ধানের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, একে বীজতলা বলে । বীজ থেকে চারা বের হলে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে বীজতলা থেকে চারাগুলিকে তুলে মূল ধান ক্ষেতে লাইন করে সম দূরত্বে রোপণ করা হয় । এই রোপনের সময় ক্ষেতে জল দাঁড়িয়ে থাকা প্রয়োজন ।

(২) বপন পদ্ধতি : বপন পদ্ধতিতে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ক্ষেতে ধানের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় । বীজ থেকে চারা গাছ বেরিয়ে ওই জমিতে ধান পাকলে ধানের পরিপক্ক শিস কেটে নেওয়া হয় ।

ধানের প্রকারভেদ :  ভারতে সাধারণত তিন শ্রেণির ধান উৎপন্ন হয়, যেমন— (১) আমন ধান, (২) আউশ ধান  ও  (৩) বোরো ধান ।

(১) আমন ধান : এই ধান চাষে প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন হয় । সেজন্য এই আমন ধান বর্ষাকালে মে-জুন মাসে বপন হয় ও শীতকালে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফসল কাটা হয় ।

(২) আউশ ধান : এই ধানের ফসল পাকতে আমন ধানের চেয়ে কম সময় লাগে । আউশ ধান চাষে আমন ধানের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে কম জলের প্রয়োজন হয় । এজন্য অপেক্ষাকৃত ঊঁচু জমিতে অথবা দেশের যে অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত কম বৃষ্টিপাত হয় সেই অঞ্চলে এই আউশ ধানের চাষ করা হয়ে থাকে । আউশ ধান মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পূর্বে বপন করে মে-জুন মাসে কাটা হয় । 

(৩) বোরো ধান :  বোরো ধান চাষে ফসল পাকতে কম সময় লাগলেও এই ধান কিছুটা নিকৃষ্ট শ্রেণির । বোরো ধান বসন্ত কালের শেষে লাগিয়ে গ্রীষ্মকালে কাটা হয় । মাত্র ষাট দিনে ফসল উৎপন্ন হয় বলে বোরো ধানকে ষেটে ধানও বলা হয় ।

উচ্চ ফলন শীল ধান : বর্তমানে ভারতে জয়া, রত্না, তাইচুং, আই আর ৮, ‘গাবিন্দ’ ও ‘আদিত্য’ আই আর ৬৪ প্রভৃতি উচ্চ ফলন শীল ধানের চাষ করা হয় ।

ধান উৎপাদক অঞ্চল : ভারতের মধ্যে বর্তমানে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম, উত্তরপ্রদেশ দ্বিতীয়, পাঞ্জাব তৃতীয়, এবং তামিলনাড়ু চতুর্থ স্থান অধিকার করে । পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম দিনাজপুর ও কুচবিহার জেলায় রাজ্যের অধিকাংশ ধান উৎপন্ন হয় । ধান উৎপাদনে বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থান অধিকার করে বলে এই জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের “ধানের ভান্ডার” বলা হয় । অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরী, উত্তরপ্রদেশের দক্ষিণাংশ, উত্তরাঞ্চল অংশের দেরাদুন অঞ্চলে এবং বিহারের উত্তরাংশের বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলে ব্যাপক হারে ধান উৎপন্ন হয় । এছাড়া ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার কটক, পুরী ও সম্বলপুর জেলা, তামিলনাড়ুর চিংলিপুট ও থাঞ্জিভুর জেলা, কর্ণাটকের উত্তর ও দক্ষিণ কানাডা জেলা, সমগ্র অসম রাজ্য, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, সিকিম, ছত্রিশগড় ও হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকাতে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় ।

ধান উৎপাদন : ধান উৎপাদনে ভারত পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে । পৃথিবীর মধ্যে ধান উৎপাদনে চিনের স্থান প্রথম । পৃথিবীর অন্যান্য ধান উৎপাদক দেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে, হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদনে ভারত বেশ পিছিয়ে আছে । চিনের ধান উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৩৩৫০ কিলোগ্রাম আর জাপানের হেক্টর প্রতি ধান উৎপাদন ৫৭০০ কিলোগ্রাম, আর ভারতে প্রতি হেক্টরে মাত্র ১৯৯০ কিলোগ্রাম ধান উৎপাদিত হয় ।

ভারতের মধ্যে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করলেও হেক্টর প্রতি বা বিঘা প্রতি ধান উৎপাদনে পাঞ্জাব রাজ্য ভারতে শীর্ষস্থান অধিকার করে ।

ধান গবেষনা কেন্দ্র : ভারতের উল্লেখযোগ্য ধান গবেষণাকেন্দ্র হল  (১) সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (কটক), (২) ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ বা পুসা ইনস্টিটিউট (দিল্লি) এবং (৩) এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত গবেষণা কেন্দ্র ও রাষ্ট্রীয় খামারে ধান সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা হয়ে থাকে ।

বাণিজ্য : কয়েক বছর আগেও ভারতকে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হত । কিন্তু ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৮ সাল থেকে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । বরং ভারতই ১৯৭৯ সাল থেকে অল্প পরিমাণ মিহি চাল বিদেশে রপ্তানি করছে ।

*****

Related Items

নর্মদা নদী (The Narmada)

নর্মদা নদী (The Narmada) : মহাকাল পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অমরকন্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে নর্মদা নদী উত্তর-পশ্চিমে বেঁকে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরার সংকীর্ণ গিরিখাত অতিক্রম করে

ব্রহ্মপুত্র নদ (The Brahmaputra)

ব্রহ্মপুত্র নদ : তিব্বতের মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমায়ুং-দুং হিমবাহ থেকে সাংপো নামে উৎপন্ন হয়ে নামচাবারওয়া শৃঙ্গের কাছে চুলের কাটার মত বেঁকে অরুণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে ডিহং নামে ভারতে প্রবেশ করেছে । এর মোট দৈর্ঘ্য ২,৯০০ কিমি, এর মধ্

সিন্ধু নদ (The Indus)

সিন্ধু নদ : সিন্ধু নদ তিব্বতের মানস সরোবরের উত্তরে অবস্থিত সিন-কা-বাব জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রথমে তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে লাদাখ অঞ্চল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে । সিন্ধু নদের মোট দৈর্ঘ্য ৩,১৮০ কিমি এবং এর মধ

গঙ্গা নদী (The Ganges)

গঙ্গা নদী : গঙ্গা ভারতের শ্রেষ্ঠ নদী এবং ভারতের দীর্ঘতম নদী । গঙ্গানদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিমি এবং এর মধ্যে ২০১৭ কিমি ভারতে প্রবাহিত । কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষার গুহা থেকে ভাগীরথী নামে উৎপন্ন হয়ে সংকীর্ণ গিরিখাতের

ভারতের নদনদী (Rivers of India)

ভারতের নদনদী : ভারতে অসংখ্য নদনদী বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে । উৎস, প্রবাহের অঞ্চল, এবং মোহানা অনুসারে ভারতের নদনদীকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যেমন— (১) উত্তর ভারতের নদী এবং (২) দক্ষিণ ভারতের নদী ।