ধীবর-বৃত্তান্ত — কালিদাস
মহর্ষি কণ্বের তপোবনে তাঁর অনুপস্থিতিতে শকুন্তলাকে বিয়ে করে রাজা দুষ্মন্ত রাজধানীতে ফিরে গেছেন । কিন্তু দীর্ঘ সময় পরেও শকুন্তলার খোঁজ নিতে কোনো দূত তপোবনে এল না । স্বামীর চিন্তায় যখন শকুন্তলা অন্যমনা তখন তপোবনে এলেন ঋষি দুর্বাসা । শকুন্তলা তা টের না পাওয়ায় ঋষি অপমানিত বোধ করলেন এবং অভিশাপ দিলেন, যাঁর চিন্তায় সে মগ্ন, সেই ব্যক্তি শকুন্তলাকে ভুলে যাবেন । শেষপর্যন্ত সখী প্রিয়ংবদার অনুরোধে ঋষি বললেন যে, কোনো নিদর্শন দেখাতে পারলে তবে শাপের প্রভাব দূর হবে ।
দুষ্মন্ত রাজধানীর উদ্দেশ্যে বিদায় গ্রহণের সময় শকুন্তলাকে যে আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন, সখীরা মনে করলেন সেই আংটিই হবে ভবিষ্যতের স্মারকচিহ্ন ।
মহর্ষি কণ্ব তীর্থ থেকে ফিরে শকুন্তলাকে পতিগৃহে পাঠানোর আয়োজন করলেন । দুষ্মন্ত-সমীপে উপস্থিত হলে তিনি শকুন্তলাকে চিনতেও পারলেন না । এদিকে পথে শচীতীর্থে স্নানের পর অঞ্জলি দেওয়ার সময় হাত থেকে খুলে পড়ে গেছে শকুন্তলার হাতের আংটি । শকুন্তলা অপমানিতা হলেন রাজসভায় ।
ঘটনাক্রমে সেই আংটি পেল এক ধীবর .......
( তারপর নগর-রক্ষায় নিযুক্ত রাজ-শ্যালক এবং পিছনে হাতবাঁধা অবস্থায় এক পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে দুই রক্ষীর প্রবেশ ।)
দুই রক্ষী— ( তাড়না করে ) ওরে ব্যাটা চোর, বল— মণিখচিত, রাজার নাম খোদাই করা এই (রাজার) আংটি তুই কোথায় পেলি ?
পুরুষ—( ভয় পাওয়ার অভিনয় করে ) আপনারা শান্ত হন । আমি এরকম কাজ (অর্থাৎ চুরি) করিনি ।
প্রথম রক্ষী— তবে কি তোকে সদ ব্রাহ্মণ বিবেচনা করে রাজা এটা দান করেছেন ?
পুরুষ— আপনারা অনুগ্রহ করে শুনুন । আমি একজন জেলে, শক্রাবতারে আমি থাকি ।
দ্বিতীয় রক্ষী— ব্যাটা বাটপাড়, আমরা কি তোর জাতির কথা জিজ্ঞাসা করেছি ?
শ্যালক— সূচক, একে পূর্বাপর সব বলতে দাও । মধ্যে বাধা দিয়ো না ।
দুই রক্ষী— তা আপনি যা আদেশ করেন । বল্ কী বলছিলি ।
পুরুষ— আমি জাল, বড়শি ইত্যাদি নানা উপায়ে মাছ ধরে সংসার চালাই ।
শ্যালক— ( হেসে ) তা তোর জীবিকা বেশ পবিত্র বলতে হয় দেখছি ।
পুরুষ— শুনুন মহাশয়, এরকম বলবেন না ।
যে বৃত্তি নিয়ে যে মানুষ জন্মেছে, সেই বৃত্তি নিন্দনীয় (ঘৃণ্য) হলেও তা পরিত্যাগ করা উচিত নয় । বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ স্বভাবে দয়াপরায়ণ হলেও যজ্ঞীয় পশুবধের সময় নির্দয় হয়ে থাকেন ।
শ্যালক— তারপর, তারপর ?
পুরুষ— একদিন একটা রুই মাছ যখন আমি খণ্ড খণ্ড করে কাটলাম, তখন সেই মাছের পেটের মধ্যে মণিমুক্তায় ঝলমলে এই আংটিটা দেখতে পেলাম । পরে সেই আংটিটা বিক্রি করার জন্য যখন লোককে দেখাচ্ছিলাম তখন আপনারা আমায় ধরলেন । এখন মারতে হয় মারুন, ছেড়ে দিতে হয় ছেড়ে দিন । কীভাবে এই আংটি আমার কাছে এল— তা বললাম ।
শ্যালক— জানুক, এর গা থেকে কাঁচা মাংসের গন্ধ আসছে । এ অবশ্যই গোসাপ-খাওয়া জেলে হবে । তবে আংটি পাবার ব্যাপারে যা বলল তা একবার অনুসন্ধান করে দেখতে হবে । সুতারাং রাজবাড়িতেই যাই ।
দুই রক্ষী— তবে তাই হোক । চল রে গাঁটকাটা !
( সবাই এগিয়ে চললেন )
শ্যালক— সূচক, সদর দরজায় সাবধানে এই চোরকে নিয়ে অপেক্ষা কর । ইতিমধ্যে এই আংটি কীভাবে পাওয়া গেল সে-সব বিষয় মহারাজকে নিবেদন করে তাঁর আদেশ নিয়ে ফিরছি ।
দুই রক্ষী— আপনি প্রবেশ করুন । মহারাজের এ সংবাদ শুনে খুব খুশি হবেন ।
(রাজশ্যালক বেরিয়ে গেলেন)
প্রথম রক্ষী— আমাদের প্রভুর দেখি খুব বিলম্ব হচ্ছে ।
দ্বিতীয় রক্ষী— আরে বাবা, অবসর বুঝে তবে না রাজার কাছে যাওয়া যায় ।
প্রথম রক্ষী— জানুক, একে মারার আগে (এর গলায় যে) ফুলের মালা পরানো হবে, তা গাঁথতে আমার হাত দুটো (এখনই) নিশপিশ করছে । (জেলেকে দেখিয়ে দিল )
পুরুষ ( জেলে )— মহাশয়, বিনা দোষে আমাকে মারবেন না ।
দ্বিতীয় রক্ষী—( তাকিয়ে দেখে ) এই তো আমাদের প্রভূ, মহারাজের হুকুমনামা হাতে নিয়ে এদিকে আসছেন । হয় তোকে শকুনি দিকে খাওয়ানো হবে, না হয় কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে ।
(রাজশ্যালক প্রবেশ করে )
শ্যালক— সূচক, এই জেলেকে ছেড়ে দাও । আংটি পাওয়ার ব্যাপারে এ যা বলছে তা সব সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে ।
সূচক— তা প্রভু যা আদেশ করেন ।
দ্বিতীয় রক্ষী— এই জেলে যমের বাড়ি গিয়ে আবার ফিরে এল । ( জেলের হাতের বাঁধন খুলে দিল )
পুরুষ— (শ্যালককে প্রণাম করে) প্রভু, আজ আমার সংসার চলবে কীভাবে ?
শ্যালক— মহারাজ আংটির মূল্যের সমান পরিমাণ এই অর্থ খুশি হয়ে তোমায় দিয়েছেন । ( জেলেকে টাকা দিলেন)
পুরুষ— ( প্রণাম করে গ্রহণ করে ) প্রভু, অনুগৃহীত হলাম ।
সূচক— এ কি যা-তা অনুগ্রহ ! এ যে শূল থেকে নামিয়ে একেবারে হাতির পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো —
জানুক— হুজুর, যে পরিমাণ পারিতোষিক দেখছি— তাতেই বোঝা যাচ্ছে সেই আংটিটা রাজার (খুব) প্রিয় ছিল ।
শ্যালক— দামি রত্ন বসানো বলেই আংটিটা রাজার কাছে মূল্যবান মনে হয়েছে— এমনটা আমার মনে হয় না । সেই আংটি দেখে মহারাজের কোনো প্রিয়জনের কথা মনে পড়েছে । স্বভাবত গম্ভীর প্রকৃতির হলেও মুহূর্তের জন্য রাজা বিহ্বলভাবে চেয়ে রইলেন ।
সূচক— তাহলে আপনি মহারাজের একটা সেবা করলেন বলতে হয় ।
জানুক— তার চেয়ে বল— এই জেলের সেবা করলেন । ( জেলেকে হিংসায় ভরা দৃষ্টিতে দেখলেন )
পুরুষ (জেলে )—মহাশয়, এই পারিতোষিকের অর্ধেক আপনাদের ফুলের দাম হিসাবে দিচ্ছি ।
জানুক— এটা তুমি ঠিকই বলেছ ।
শ্যালক— শোনো ধীবর, এখন থেকে তুমি আমার একজন বিশিষ্ট প্রিয় বন্ধু হলে ।
( সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত )
তরজমা : সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী
****