পথের দাবী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পুলিশ-স্টেশনে প্রবেশ করিয়া দেখা গেল, সুমুখের হলঘরে জন-ছয়েক বাঙালি মোট-ঘাট লইয়া বসিয়া আছে, জগদীশবাবু ইতিমধ্যেই তাহাদের টিনের তোরঙ্গ ও ছোটৈ-বড়ো পুঁটলি খুলিয়া তদারক শুরু করিয়া দিয়াছেন । শুধু যে লোকটির প্রতি তাঁহার অত্যন্ত সন্দেহ হইয়াছে তাহাকে আর একটা ঘরে আটকাইয়া রাখা হইয়াছে । ইহারা সকলেই উত্তর-ব্রহ্মে বর্মা-অয়েল-কোম্পানির তেলের খনির কারখানায় মিস্ত্রির কাজ করিতেছিল, সেখানের জলহাওয়া সহ্য না হওয়ায় চাকরির উদ্দেশ্যে রেঙ্গুনে চলিয়া আসিয়াছে । ইহাদের নাম ধাম ও বিবরণ লইয়া ও সঙ্গের জিনিসপত্রের পরীক্ষা করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইলে, পোলিটিক্যাল সাসপেক্ট সব্যসাচী মল্লিককে নিমাইবাবুর সম্মুখে হাজির করা হইল । লোকটি কাশিতে কাশিতে আসিল । অত্যন্ত ফরসা রং রৌদ্রে পুড়িয়া যেন তামাটে হইয়াছে । বয়স ত্রিশ-বত্রিশের অধিক নয়, কিন্তু ভারী রোগা দেখাইল । এইটুকু কাশির পরিশ্রমেই সে হাঁপাইতে লাগিল । সহসা আশঙ্কা হয়, সংসারের মিয়াদ বোধ করি বেশি দিন নাই; ভিতরের কী একটা দুরারোগ্য রোগে সমস্ত দেহটা যেন দ্রুতবেগে ক্ষয়ের দিকে ছুটিয়াছে । কেবল আশ্চর্য সেই রোগা মুখের অদ্ভুত দুটি চোখের দৃষ্টি । সে চোখ ছোটো কি বড়ো, টানা কি গোল, দীপ্ত কি প্রভাহীন এ-সকল বিবরণ দিতে যাওয়াই বৃথা—অত্যন্ত গভীর জলাশয়ের মতো কী যে তাহাতে আছে, ভয় হয় এখানে খেলা চলিবে না, সাবধানে দূরে দাঁড়ানোই প্রয়োজন । ইহারাই কোন অতল তলে তাহার ক্ষীন প্রাণশক্তিটুকু লুকানো আছে, মৃত্যুও সেখানে প্রবেশ করিতে সাহস করে না । —কেবল এই জন্যই যেন সে আজও বাঁচিয়া আছে । অপূর্ব মুগ্ধ হইয়া সেইদিকে চাহিয়া ছিল, সহসা নিমাইবাবু তাহার বেশভূষার বাহার ও পরিপাট্যের প্রতি অপূর্বর দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া সহাস্যে কহিলেন, বাবুটির স্বাস্থ্য গেছে, কিন্তু শখ ষোলাোআনাই বজায় আছে তা স্বীকার করতে হবে । কী বল অপূর্ব ?
এতক্ষণে অপূর্ব তাহার পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিল । তাহার মাথার সম্মুখদিকে বড়ো বড়ো চুল, কিন্তু ঘাড় ও কানের দিকে নাই বলিলেই চলে, —এমনি ছোটো করিয়া ছাঁটা । মাথায় চেরা সিঁথি, —অপর্যাপ্ত তৈলনিষিক্ত, কঠিন, রুগ্ন, কেশ হইতে নিদারুণ নেবুর তেলের গন্ধে ঘর ভরিয়া উঠিয়াছে । গায়ে জাপানি সিল্কের রামধনু রঙের চুড়িদার পাঞ্জাবি, তাহার বুক-পকেট হইতে বাঘ-আঁকা একটা রুমালের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে, উত্তরীয়ের কোনো বালাই নাই । পরনে বিলাতি মিলের কালো মকমল পাড়ের সুক্ষ শাড়ি, পায়ে সবুজ রঙের ফুল মোজা — হাটুর উপরে লাল ফিতা দিয়া বাঁধা, বার্নিশ-করা পাম্প শু, তলাটা মজবুত ও টিকসই করিতে আগাগোড়া লোহার নাল বাঁধানো, হাতে একগাছি হরিণের শিঙের হাতল দেওয়া বেতের ছড়ি, —কয়দিনের জাহাজের ধকলে সমস্তই নোংরা হইয়া উঠিয়াছে, —ইহার আপাদমস্তক অপূর্ব বারবার নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, কাকাবাবু, এ লোকটিকে আপনি কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই ছেড়ে দিন, যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি ।
নিমাইবাবু চুপ করিয়া রহিলেন । অপূর্ব কহিল, আর যাই হোক, যাঁকে খুঁজছেন তাঁর কালচরের কথাটা একবার ভেবে দেখুন ।
নিমাইবাবু হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন, কহিলেন, তোমার নাম কী হে ?
আজ্ঞে, গিরীশ মহাপাত্র ।
একদম মহাপাত্র । তুমিও তেলের খনিতেই কাজ করছিলে, না ? এখন রেঙ্গুনেই থাকবে ? তোমার বাক্স বিছানা তো খানাতল্লাশি হয়ে গেছে, দেখি তোমার ট্যাঁকে এবং পকেটে কী আছে ?
তাহার ট্যাঁক হইতে একটি টাকা ও গণ্ডা-ছয়েক পয়সা বাহির হইল, পকেট হইতে একটা লোহার কম্পাস, মাপ করিবার কাঠের একটা ফুটরুল, কয়েকটা বিড়ি, একটা দেশলাই ও একটা গাঁজার কলিকা বাহির হইয়া পড়িল ।
নিমাইবাবু কহিলেন, তুমি গাঁজা খাও ?
লোকটি অসঙ্কোচে জবাব দিল, আজ্ঞে না ।
তবে এ বস্তুটি পকেটে কেন ?
আজ্ঞে, পথে কুড়িয়ে পেলাম, যদি কারও কাজে লাগে তাই তুলে রেখেচি ।
জগদীশবাবু এই সময়ে ঘরে ঢুকিতে নিমাইবাবু হাসিয়া কহিলেন, দেখো জগদীশ, কীরূপ সদাশয় ব্যক্তি ইনি । যদি কারও কাজে লাগে তাই গাঁজার কলকেটি কুড়িয়ে পকেটে রেখেছেন । ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, গাঁজা খাবার সমস্ত লক্ষণই তোমাতে বিদ্যমান বাবা, বললেই পারতে, খাই । কিন্তু ক'দিনই বা বাচঁবে, —এই তো তোমার দেহ, —আর খেয়ো না । বুড়োমানুষের কথাটা শুনো ।
মহাপাত্র মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল, আজ্ঞে না মাইরি খাইনে । তবে ইয়ার বন্ধু কেউ তৈরি করে দিতে বললে দিই, —এই মাত্র ! নইলে নিজে খাইনে ।
জগদীশবাবু চটিয়া উঠিয়া কহিলেন, দয়ার সাগর ! পরকে সেজে দি, নিজে খাইনে । মিথ্যেবাদী কোথাকার !
অপূর্ব কহিল, বেলা হয়ে গেল, আমি এখন তবে চললুম কাকাবাবু ।
নিমাইবাবু উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো মহাপাত্র । কী বল জগদীশ, পারে তো ? জগদীশ সম্মতি জানাইলে কহিলেন, কিন্তু নিশ্চয় কিছুই বলা যায় না ভায়া, আমার মনে হয় এ শহরে আরও কিছুদিন নজর রাখা দরকার । রাত্রের মেল ট্রেনটার প্রতি একটু দৃষ্টি রেখো, সে যে বর্মায় এসেছে এ খবর সত্য ।
জগদীশ কহিলেন, তা হতে পারে, কিন্তু এই জানোয়ারটাকে ওয়াচ করবার দরকার নেই বড়োবাবু । নেবুর তেলের গন্ধে ব্যাটা থানাশুদ্ধ লোকের মাথা ধরিয়ে দিলে ! বড়োবাবু হাসিতে লাগিলেন । অপূর্ব পুলিশ-স্টেশন হইতে বাহির হইয়া আসিল, এবং প্রায় তাহার সঙ্গে সঙ্গেই মহাপাত্র তাঁহার ভাঙ্গা টিনের তোরঙ্গ ও চাটাই-জড়ানো ময়লা বিছানার বাণ্ডিল বগলে চাপিয়া ধীর মন্থরপদে উত্তর দিকের রাস্তা ধরিয়া সোজা প্রস্থান করিল ।
আশ্চর্য্য এই যে, এত বড়ো সব্যসাচী ধরা পড়িল না, কোনো দুর্ঘটনা ঘটিল না এমন সৌভাগ্যকেও অপূর্বর মন যেন গ্রাহ্যই করিল না । বাসায় ফিরিয়া দাড়ি-গোঁফ কামানো হইতে শুরু করিয়া সন্ধ্যাহ্নিক, স্নানাহার, পোশাক-পরা, আফিস যাওয়া প্রভৃতি নিত্য কাজগুলায় বাধা পাইল না সত্য, কিন্তু ঠিক কী যে সে ভাবিতে লাগিল তাহার নির্দেশ নাই, অথচ চোখ-কান ও বুদ্ধি তাহার সাংসারিক সকল ব্যাপার হইতেই একেবারে যেন বিচ্ছিন্ন হইয়া কোন এক অদৃষ্ট অপরিজ্ঞাত রাজবিদ্রোহীর চিন্তাতেই ধ্যানস্থ হইয়া রহিল । এই অত্যন্ত অন্যমনস্কতা তলওয়ারকর লক্ষ করিয়া চিন্তিতমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আজ বাড়ি থেকে কোন চিঠি পেয়েছেন নাকি ?
কৈ না ।
বাড়ির খবর সব ভালো তো ?
অপূর্ব কিছু আশ্চর্য হইয়া কহিল, যতদূর জানি সবাই ভালোই তো আছেন ।
রামদাস আর কোনো প্রশ্ন করিল না । টিফিনের সময় উভয়ে একত্র বসিয়া জলযোগ করিত । রামদাসের স্ত্রী অপূর্বকে একদিন সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছিলেন, যতদিন তাঁহার মা কিংবা বাটীর আর কোনো আত্মীয়া নারী এদেশে আসিয়া বাসার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি না করেন ততদিন এই ছোটো বহিনের হাতের তৈরি যৎসামান্য মিষ্টান্ন প্রত্যহ তাঁহাকে গ্রহণ করিতেই হইবে । অপূর্ব রাজি হইয়াছিল । আফিসের একজন ব্রাহ্মন পিয়াদা এই-সকল বহিয়া আনিত । আজও সে নিরালা পাশের ঘরটায় ভোজ্যবস্তুগুলি যখন সাজাইয়া দিয়া গেল, তখন আহারে বসিয়া অপূর্ব নিজেই কথা পাড়িল । কাল তাহার ঘরে চুরি হইয়া গেছে; সমস্তই যাইতে পারিত, কেবল উপরের সেই ক্রিশ্চান মেয়েটির কৃপায় টাকাকড়ি ছাড়া আর সমস্ত বাঁচিয়াছে । সে চোর তাড়াইয়া দরজায় নিজের তালা বন্ধ করিয়াছে, আমি বাসায় পৌছিলে চাবি খুলিয়া দিয়া অনাহূত আমার ঘরে ঢুকিয়া ছড়ানো জিনিসপত্র গুছাইয়া দিয়াছে, সমস্ত ফর্দ করিয়া কী আছে আর কি গেছে তার এমন নিখুঁত হিসাব করিয়া দিয়াছে যে বোধ হয় তোমার মত পাশ-করা অ্যাকাউন্টেন্টের পক্ষেও বিস্ময়কর । বাস্তবিক, এমন তৎপর, এতবড়ো কার্যকুশলা মেয়ে আর যে কেহ আছে মনে হয় না হে তলওয়ারকর ! তা ছাড়া এত বড়ো বন্ধু !
রামদাস কহিল, তার পর ?
অপূর্ব বলিল, তেওয়ারি ঘরে ছিল না, বর্মা নাচ দেখতে ফয়ায় গিয়েছিল, ইত্যবসরে এই ব্যাপার । তার বিশ্বাস এ কাজ ও ছাড়া আর কেউ করেনি । আমারও অনুমান কতকটা তাই । চুরি না করুক, সাহায্য করেচে ।
তার পর ?
তারপর সকালে গেলাম পুলিশে খবর দিতে । কিন্তু পুলিশের দল এমন কাণ্ড করলে, এমন তামাশা দেখালে যে ও-কথা আর মনেই হলো না । এখন ভাবচি, যা গেছে তা যাক, তাদের চোর ধরে দিয়ে আর কাজ নেই, তারা বরঞ্চ এমনিধারা বিদ্রোহী ধরে ধরেই বেড়াক । এই বলিয়া তাহার গিরীশ মহাপাত্র ও তাহার পোশাক-পরিচ্ছদের বাহার মনে পড়িয়া হঠাৎ হাসির ছটায় যেন দম আটকাইবার উপক্রম হইল । হাসি থামিলে সে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধারণ পারদর্শী বিলাতের ডাক্তার উপাধিধারী রাজশত্রু মহাপাত্রের স্বাস্থ্য, তাহার শিক্ষা ও রুচি, তাহার বল-বীর্য, তাহার রামধনু রঙের জামা, সবুজ রঙের মোজা ও লোহার নালঠোকা পাম্প শু, তাহার নেবুর তেলের গন্ধবিলাস, সর্বোপরি তাহার পরহিতায় গাঁজার কলিকাটির আবিষ্কারের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করিতে করিতে তাহার উৎকট হাসির বেগ কোনোমতে আর একবার সংবরণ করিয়া শেষে কহিল, তলওয়ারকর, মহা হুঁশিয়ার পুলিশের দলকে আজকের মতো নির্বোধ আহম্মক হতে বোধ করি কেউ কখনো দেখেনি । অথচ, গভর্নমেন্টের কত টাকাই না এরা বুনো হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি করে অপব্যয় করলে !
রামদাস হাসিয়া কহিল, কিন্তু বুনো হাঁস ধরাই যে এদের কাজ; আপনার চোর ধরে দেবার জন্যে এরা নেই । আচ্ছা, এরা কি আপনাদের বাংলা দেশের পুলিশ ?
অপূর্ব কহিল, হাঁ । তা ছাড়া আমার বড়ো লজ্জা এই যে এদের যিনি কর্তা তিনি আমার আত্মীয়, আমার পিতার বন্ধু । বাবাই একদিন এঁর চাকরি করে দিয়েছিলেন ।
রামদাস কহিল, তাহলে আপনাকেই হয়তো আর একদিন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে । কিন্তু কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে-ই একটু অপ্রতিভ হইয়া চুপ করিল,—আত্মীয়ের সম্বন্ধে এরূপ একটা মন্তব্য প্রকাশ করা হয়তো শোভন হয় নাই । অপূর্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া অর্থ বুঝিল, কিন্তু এই ধারণা যে সত্য নয়, ইহাই সতেজে ব্যক্ত করিতে সে জোর করিয়া বলিল, আমি তাঁকে কাকা বলি, আমাদের তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের চেয়ে তো তিনি আপনার নন । বরঞ্চ, যাঁকে তিনি দেশের টাকায়, দেশের লোক দিয়ে শিকারের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছেন তিনি ঢের বেশি আমার আপনার ।
রামদাস মুচকিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বাবুজি এ-সব কথা বলার দুঃখ আছে । অপূর্ব কহিল, থাকে, তাই নেব । কিন্তু তাই বলে তলওয়ারকর, —শুধু কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর যে-কোনো দেশে, যে-কোনো যুগে যে-কেউ জন্মভূমিকে তার স্বাধীন করবার চেষ্টা করেচে, তাকে আপনার নয় বলবার সাধ্য আর যার থাক আমার নেই । বলিতে বলিতে কন্ঠস্বর তাহার তীক্ষ্ণ এবং চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল; মনে মনে বুঝিল কী কথায় কী কথা আসিয়া পড়িতেছে, কিন্তু সামলাইতে পারিল না, বলিল, তোমার মতো সাহস আমার নেই, আমি ভীরু, কিন্তু তাই বলে অবিচারে দণ্ডভোগ করার অপমান আমাকে কম বাজে না রামদাস । বিনা দোষে ফিরিঙ্গি ছোঁড়ারা আমাকে যখন লাথি মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে বার করে দিলে, এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ যখন করতে গেলাম, তখন সাহেব স্টেশনমাস্টার কেবলমাত্র আমাকে দেশি লোক বলেই দেশের স্টেশন থেকে কুকুরের মতো দূর করে দিলে, — তার লাঞ্ছনা এই কালো চামড়ার নীচে কম জ্বলে না তলওয়ারকর ! এমন তো নিত্য-নিয়তই ঘটেচে, —আমার মা, আমার ভাই-বোনকে যারা এই-সব সহস্র কোটি অত্যাচার থেকে উদ্ধার করতে চায় তাদের আপনার বলে ডাকবার যে দুঃখই থাক আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম ।
রামদাসের সুশ্রী গৌরবর্ণ মুখ ক্ষণকালের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, কৈ এ ঘটনা তো আমাকে বলেন নি ?
অপূর্ব কহিল, বলা কি সহজ রামদাস ? হিন্দুস্তানের লোক সেখানে কম ছিল না, কিন্তু আমার অপমান কারও গায়েই ঠেকল না এমনি তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে । লাথির চোটে আমার যে হাড়-পাঁজরা ভেঙে যায়নি এই সুখবরে তারা সব খুশি হয়ে গেল । তোমাকে জানাব কি—মনে হলে দুঃখে লজ্জায় ঘৃণায় নিজেই যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাই ।
রামদাস চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার দুই চোখ ছলছল করিয়া আসিল । সম্মুখের ঘড়িতে তিনটা বাজিতে সে উঠিয়া দাড়াইল । বোধ হয় কী একটা বলিতে গেল, কিন্তু কিছুই না বলিয়া হঠাৎ হাত বাড়াইয়া অপূর্বর ডান হাতটা টানিয়া লইয়া একটা চাপ দিয়া নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলিয়া গেল ।
সেই দিন বিকালে আফিসের ছুটি হইবার পূর্বে বড়োসাহেব একখানা লম্বা টেলিগ্রাম হাতে অপূর্বর ঘরে ঢুকিয়া কহিলেন, আমাদের ভামোর আফিসে কোনো শৃঙ্খলাই হচ্চে না । ম্যানডোলে, শোএবো, মিকথিলা এবং এদিকে প্রোম সব-কটা আফিসেই গোলযোগ ঘটচে । আমার ইচ্ছা তুমি একবার সবগুলো দেখে আস । আমার অবর্তমানে সমস্ত ভারই তো তোমার, —একটা পরিচয় থাকা চাই, —সুতরাং বেশি দেরি না করে কাল-পরশু যদি একবার—
অপূর্ব তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, আমি কালই বার হয়ে যেতে পারি । বস্তুত, নানা কারণে রেঙ্গুনে তাহার আর একমুহূর্ত মন টিকিতে ছিল না । উপরন্তু, এই সূত্রে দেশটাও একবার দেখা হইবে । অতএব যাওয়াই স্থির হইল, এবং পরদিনই অপরাহ্ণবেলায় সুদুর ভামো নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিয়া সে ট্রেনে চাপিয়া বসিল । সঙ্গে রহিল আরদালি এবং আফিসের একজন হিন্দুস্তানি ব্রাহ্মণ পিয়াদা । তেওয়ারি খবরদারির জন্য বাসাতেই রহিল । পা-ভাঙ্গা সাহেব হাসপাতালে পড়িয়া, সুতরাং তেমন আর ভয় নাই । বিশেষত, এই রেঙ্গুন শহরটা বরং সহিয়াছিল, কিন্তু আরও অজানা স্থানে পা বাড়াইবার তাহার প্রবৃত্তিই ছিল না । তলওয়ারকর তেওয়ারির পিঠ ঠুকিয়া দিয়া সাহস দিয়া কইিল, তোমার চিন্তা নেই ঠাকুর, কোনো কিছু হলেই আফিসে গিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়ো ।
গাড়ি ছাড়িতে বোধ করি তখনও মিনিট-পাঁচেক বিলম্ব ছিল, অপূর্ব হঠাৎ চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, ওই যে ।
তলওয়ারকর ঘাড় ফিরাইতেই বুঝিল, এই সেই গিরীশ মহাপাত্র । সেই বাহারে জামা, সেই সবুজ রঙের ফুল মোজা, সেই পাম্প শু এবং ছড়ি, প্রভেদের মধ্যে এখন কেবল সেই বাঘ-আঁকা রুমালখানি বুকপকেটে ছাড়িয়া তাঁহার কন্ঠে জড়ানো । মহাপাত্র এই দিকেই আসিতেছিল, সম্মুখে আসিতেই অপূর্ব ডাকিয়া কহিল, কি হে গিরীশ, আমাকে চিনতে পারো ? কোথায় চলেচ ?
গিরীশ শশব্যস্তে একটা মস্ত নমস্কার করিয়া কহিল, আজ্ঞে, চিনতে পারি বৈ কি বাবুমশায় । কোথায় আগমন হচ্ছেন ?
অপূর্ব সহাস্যে কহিল, আপাতত ভামো যাচ্চি । তুমি কোথায় ?
গিরীশ কাহিল, আজ্ঞে, এনাঞ্জাং থেকে দুজন বন্ধু নোক আসার কথা ছিল, — আমাকে কিন্তু বাবু ঝুটমুট হয়রান করা । হাঁ, আনে বটে কেউ কেউ আপিং সিদ্ধি নুকিয়ে, কিন্তু, আমি বাবু ভারী ধর্মভীরু মানুষ । বলি কাজ কি বাপু জুচ্চুরিতে — কথায় বলে পরোধর্ম ভয়াবয় । লল্লাটের লেখা তো খণ্ডাবে না ।
অপূর্ব হাসিয়া কহিল, আমারও তো তাই বিশ্বাস । কিন্তু তোমার বাপু একটা ভুল হয়েছে, আমি পুলিশের লোক নই, আফিম সিদ্ধির কোনো ধার ধারিনে, — সেদিন কেবল তামাশা দেখতেই গিয়েছিলাম ।
তলওয়ারকর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতেছিল, কহিল, বাবুজি, ম্যয় নে আপকো তো জরুর কঁহা দেখা —
গিরীশ কহিল, আশ্চয্যি নেহি হ্যায় বাবু সাহেব, নোকরির বাস্তে কেত্তা যায়গায় তো ঘুমতা হ্যায়, —
অপূর্বকে বলিল, কিন্তু আমার ওপর মিথ্যে সন্দেহ, রাখবেন না বাবুমশায়, আপনাদের নজর পড়লে চাকরিও একটা জুটবে না । বামুনের ছেলে, বাংলা লেখাপড়া, শাস্তর-টাস্তর সবই কিছু কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু এমন অদেষ্ট যে — বাবুমশায় আপনারা —
অপূর্ব কহিল, আমি ব্রাহ্মণ ।
আজ্ঞে, তা হলে নমস্কার । এখন তবে আসি, — বাবুসাহেব, রাম রাম — বলিতে বলিতে গিরীশ মহাপাত্র একটা উদগত কাশির বেগ সামলাইয়া লইয়া ব্যগ্রপদে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল ।
অপূর্ব কাহিল, এই সব্যসাচীটির পিছনেই কাকাবাবু সদলবলে এদেশ ওদেশ করে বেড়াচ্ছেন তলওয়ারকর । বলিয়া সে হাসিল । কিন্তু এই হাসিতে তলওয়ারকর যোগ দিল না । পরক্ষণে বাঁশি বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলে সে হাত বাড়াইয়া বন্ধুত্ব করমর্দন করিল, কিন্তু তখনও মুখ দিয়া তাহার কথাই বাইর হইল না । নানা কারণে অপূর্ব লক্ষ করিল না, কিন্তু করিলে দেখিতে পাইত এই মুহুর্তকালের মধ্যে রামদাসের প্রশস্ত উজ্জ্বল ললাটের উপরে যেন কোন এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে, এবং সেই সুদূর দুর্নিরীক্ষ্য লোকেই তাহার সমস্ত মনশ্চক্ষু একেবারে উধাও হইয়া গিয়াছে ।
অপূর্ব প্রথম শ্রেণির যাত্রী, তাহার কামরায় আর কেহ লোক ছিল না । সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে সে পিরানের মধ্যে হইতে পৈতা বাহির করিয়া বিনা জলেই সায়ংসন্ধ্যা সমাপন করিল, এবং যে-সকল ভোজ্যবস্তু শাস্ত্রমতে স্পর্শদুষ্ট হয় না জানিয়া সে সঙ্গে আনিয়াছিল, পিতলের পাত্র হইতে বাহির করিয়া আহার করিল, জল ও পান তাহার ব্রাহ্মন আরদালি পূর্বাহ্নেই রাখিয়া গিয়াছিল, এবং শয্যাও সে প্রস্তুত করিয়া দিয়া গিয়াছিল, অতএব রাত্রির মতো অপূর্ব ভোজনাদি শেষ করিয়া হাতমুখ ধুইয়া পরিতৃপ্ত সুস্থচিত্তে শয্যা আশ্রয় করিল । তাহার ভারসা ছিল প্রভাতকাল পর্যন্ত আর তাহার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটবে না । কিন্তু ইহা যে কতবড়ো ভ্রম তাহা কয়েকটা স্টেশন পরেই সে অনুভব করিল । সেই রাত্রির মধ্যে বার-তিনেক তাহার ঘুম ভাঙ্গাইয়া পুলিশের লোক তাহার নাম ও ধাম ও ঠিকানা লিখিয়া লইয়াছে । একবার সে বিরক্ত হইয়া প্রতিবাদ করায় বর্মা সব-ইনস্পেক্টর সাহেব কটুকন্ঠে জবাব দেয়, তুমি তো ইউরোপিয়ান নও ।
অপূর্ব কহে, না । কিন্তু আমি তো ফাস্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার, — রাত্রে তো আমার তুমি ঘুমের বিঘ্ন করতে পারো না ।
সে হাসিয়া বলে, ও নিয়ম রেলওয়ে কর্মচারীর জন্য, —আমি পুলিশ; ইচ্ছা করিলে আমি তোমাকে টানিয়া নীচে নামাইতে পারি ।
**** (সম্পাদিত)