শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর এক অভূতপূর্ব স্রোত বঙ্গভুমিকে প্লাবিত করে । কাব্যে, সঙ্গীতে, জীবনে— সেই প্রাণপ্রৈতির প্রকাশ যে রূপে ও স্বরূপে ঘটে, তাকে আমরা সে যুগের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলতে পারি । ভারতীয় ভাষা সাহিত্যে অপূর্ব জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈতন্যের জীবনালোকে লিপিবদ্ধ হয় । তাঁর জীবন ও জীবনার্থ নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয় । তারমধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত' ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের 'চৈতন্যচরিতামৃত' । দুটি গ্রন্থই দুই কবি সাধকের রচনা ।
চরিত সাহিত্য বলতে আমরা বুঝি জীবনীসাহিত্য । জীবনী সাহিত্য রচনার আদর্শ হিসাবে জার্মান কবি গ্যোয়টে লেখেন, "For the main task of Biography seems to be this : to exhibit the man in relation to the circumstances of his time and to show how far everything has opposed or forwarded his progress, what kind of a view of the world and of mankind he has formed from them, and how he, if an artist, poet or writer may outwardly reflect them." একটি মানুষ যেমন একটি ভূগোলে জন্মগ্রহণ করে, তেমনি সে জন্ম নেয় ইতিহাসেও । জীবনীকার লক্ষ্য করেন কীভাবে তাঁর বর্ণনীয় ব্যক্তিত্ব ইতিহাস ও ভূগোলের সঙ্গে অন্বিত । একজন বড় মাপের মানুষ তাঁর ভৌগলিক পরিবেশ স্বজন-পরিজন জনসমষ্টির দ্বারা প্রভাবিত হন, তেমনি তাঁর ঐতিহাসিক পরিবেশও তাঁকে প্রভাবিত করে । কারণ তাঁর সংবেদনশীল সত্তায় তদানীন্তন যুগ ও জীবন বড় হয়ে দেখা দেয় । কিন্তু জীবনীকার এখানেই থেমে থাকেন না । ঘটনার অনুসঙ্গে তিনি দেখান কীভাবে একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর সময়কে প্রভাবিত করছেন, কীভাবে তাঁর স্বদেশের মানুষের জীবনশৈলী ও জীবনদৃষ্টি এই ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে বদলে যাচ্ছে । শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে জীবনীকাব্য লেখা হয়, ভারতীয় সাহিত্যে তা অভিনব । কারণ দেবতা নয় একজন মানুষও যে কাব্যের বিষয় হতে পারে এই ধারণাটাই ছিল নতুন । কিন্তু তাঁর জীবনকারদের চোখে যে চৈতন্যকে পেলাম তিনি শুধুমাত্র রক্ত-মাংসের মানুষ নন । মানবরস অবশ্যই তাঁদের লেখায় আছে, কিন্তু বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বৈষ্ণব সাধনার কথা । যে আর্তি ও রোমাঞ্চে শ্রীচৈতন্যের শেষ জীবন পুলকিত বিহ্বল, সেখানে এই পার্থিব জীবন ছাপিয়ে অসীমের ইশারা অবিরত, সেই দেবায়িত মানুষের মহিমা সংকীর্তনই ছিল জীবনীকারদের উদ্দিষ্ট । তাই তাঁদের রচনাকে জীবনচরিত না বলে চরিতামৃত বলাই সম্ভবত যুক্তিযুক্ত ।
জীবনচরিত ও চরিতামৃতের পার্থক্য স্পষ্ট হওয়া দরকার । যে জীবনকার ধুলিমাটির রক্ত-মাংসের মানুষকে অবলম্বন করে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মহত্ব বিশ্লেষণ করেন, তাঁর রচিত জীবনকথা অবশ্যই চরিতসাহিত্য । কিন্তু সেখানে আমরা দেখি আধ্যাত্বিকতার প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য, যেখানে একটি মর্ত্য মানুষকে নিয়ে অমর্ত্যের সন্ধানই বড় হয়ে দেখা দেয়, তাকে চরিতামৃত অভিধায় চিহ্নিত করা যায় । কারণ এই চরিত কথনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় অমৃত কথন ।
বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুই মহৎ গ্রন্থ । চৈতন্যভাগবতে শ্রীচৈতন্যের আদি ও মধ্য জীবনের কথা বিস্তারিতভাবে লেখা হয়, চৈতন্য চরিতামৃতে আদি ও মধ্য জীবনের কথা নেই তা নয় কিন্তু যে অপার্থিব বেদনায় তাঁর অন্ত জীবন অনন্ত অভিসারী, সেই শেষ পর্যায়ের অমৃতময়, চৈতন্যময় চৈতন্যজীবনকে প্রধানত অবলম্বন করেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ । চৈতন্যভাগবতে শ্রীচৈতান্যের পার্থিব জীবন কথা যদিও অনেকটাই পাই আমরা, তবু পার্থিবতার সব কোলাহল উত্তীর্ণ হয়ে বৈকুন্ঠলোকের ইশারাই এখানে বড় হয়ে দেখা দেয় । তাই আমাদের বলতে হয় চৈতন্য ভগবত চৈতন্যচরিতামৃত জীবনীসাহিত্য হয়েও জীবন অতিক্রমী বৈকুণ্ঠ লোকের অমৃত উদ্ভাসন ।
"কৃষ্ণের যতেক খেলা, সর্বোত্তম নরলীলা " । চৈতন্যদেব সম্পর্কে একথাই বিশেষভাবে বলতে চান জীবনীকাররা । যদি প্রকৃত জীবনকথা তাঁরা লিখতে চাইতেন, তবে শ্রীচৈতন্যের জাতীয়তাবোধ, সংগঠনশক্তি, উদ্ভাবনী প্রতিভা, সংঘ পরিচালনা, ক্ষুরধার বুদ্ধি, কর্মকৌশল ইত্যাদি সবিস্তারে বলতেন । শ্রীচৈতন্য ধর্মপ্রচারের জন্য পুরীধামে জীবনের শেষ অংশ কাটান । তাই পুরিধামকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রেষ্ঠ তীর্থ হিসেবে দেখেন । কিন্তু মধ্য ও পশ্চিম ভারতে ধর্মপ্রচারের মাধ্যমে বাঙালি চিন্তা-চেতনার উপনিবেশ স্থাপনে শ্রীচৈতন্যের নিগূঢ় উদ্দেশ্য তারা লক্ষ্য করেননি । অধ্যাপক তারাপদ ভট্টাচার্য্য যথার্থই লেখেন, "বৃন্দাবন দাস ও কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্যের আচন্ডালে প্রেম বিতরণই লক্ষ্য করিয়াছেন, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের ধ্বংসাবশিষ্ট অহিন্দু বাঙালির এক বিশাল অংশকে মুসলমান ধর্মের কবল থেকে রক্ষা করে হিন্দু সমাজকে শক্তিশালী করার যে পরিকল্পনা চৈতন্যদেব গ্রহণ করিয়াছিলেন, ইহারা কেউই তা ধারণা করতে পারেন নাই ।" আরো লেখেন, "তিনি নিশ্চিত বুঝিয়া ছিলেন যে, বিধর্মী রাজশক্তির পীড়ন থেকে আত্মরক্ষা করতে হলে সংঘশক্তির প্রয়োজন ও নগর-কীর্তনের ভানোন্মত্ততার দ্বারাই একতা স্থাপন সম্ভব ।" প্রকৃতপক্ষে শ্রীচৈতন্যদেবকে বৈষ্ণবসমাজের গঠনকর্তা, নেতা ও পরিচালকরূপে দেখলে তবেই তাঁর জীবনের এক বিরাট অংশকে তুলে ধরা সম্ভব । অত্যন্ত দুঃখের কথা, চৈতন্য চরিতকাররা শ্রীচৈতন্যের কর্মজীবনকে উপেক্ষা করেন, চৈতন্যদেবের ভাবোন্মাত্ত সন্ন্যাসীরূপই তাদের বর্ণনীয় হয়ে ওঠে । তাই তাঁদের রচনা চৈতন্যচরিত হয়ে উঠল না, হল চৈতন্যচরিতামৃত— শ্রীচৈতন্যের অমৃতময় প্রেমভাবনার বার্তাবহ ।
*****