বাংলা ভাষার লেখ্যরীতিকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়— সাধু ও চলিত ভাষা । বাংলা গদ্যের সূত্রপাত থেকে এই দুই রীতি পাশাপাশি চলে এসেছে । কাব্যে ব্যবহৃত মধ্যযুগের বাংলা থেকেই যে আধুনিক সাধু ভাষার ক্রমিক উন্নয়ন, ভাষাচার্য ডঃ সুকুমার সেন তার চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ।
মধ্য বাংলা : হিত উপদেশ রাজা শ্রবণ করিয়া ।
ধীরে ধীরে উঠিলেন শয়ন ছাড়িয়া ।।
সাধু গদ্য :- হিত-উপদেশ শ্রবণ করিয়া রাজা শয়ন ছাড়িয়া ধীরে ধীরে উঠিলেন । কাব্যে ব্যবহৃত মধ্য বাংলা ও আধুনিক সাধুভাষা যে কতটা কাছাকাছি এই উদাহরণে তা স্পষ্ট । ডঃ সেন লেখেন, 'কাব্যে ব্যবহৃত মধ্য বাংলা থেকেই এই আধুনিক সাধু ভাষার শ্রমিক উন্নয়ন ঘটেছে আর দু'টি রীতির পার্থক্য কেবল পদক্রম বিন্যাসেই অঙ্গীকৃত ।' মধ্য যুগে কাব্য ভাষার আশ্রয়ে যে সাধু ভাষা গড়ে ওঠে, তাতে শুধু আঞ্চলিক রাঢ়ী ভাষারই একাধিপত্য ছিল না, বরেন্দ্রী ও বঙ্গালীর ভাষার ও প্রভাব ছিল যথেস্ট । তবে মধ্য যুগে বাংলা গদ্যের উন্মেষ হলেও এর পরিধি ছিল অত্যন্ত সীমিত । বাংলা গদ্যের প্রকৃত অনুশীলন শুরু হয় ঊনিশ শতকে । ছাপাখানা, শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা, বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের জয়যাত্রা । আর এই সময়ের গদ্য মানেই সাধু গদ্যকেই বোঝাত । ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে রচিত সাধু গদ্যের একটি নিদর্শন —"নির্মল সুস্নিগ্ধ জল পুষ্করিনী তটস্থলে বটবিটচ্ছায়াতে নিদাঘকালীন দিবাবসান সময়ে বটজটাতে ঘোটক বন্ধন করিয়া নিজ ভৃত্য জনসমাজাগন প্রতীক্ষাতে উপবিষ্ট হইলেন " — ( প্রোবধচন্দ্রিকা ) । এই বাংলা গদ্যে শ্রী এবং শৃঙ্খলার অভাব ছিল । ধীরে ধীরে এই অবস্থার অবসান ঘটে । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবির্ভাবে বাংলা গদ্যের একটা নতুন দিক উন্মোচিত হয় । —"শকুন্তলা, অনুসূয়া ও প্রিয়াংবদা নামে দুই সহচরীর সহিত বৃক্ষবটিকাতে উপস্থিত হইয়া, আলবালে জলসেচন করিতে আরম্ভ করিলেন । অনুসুয়া পরিহাস করিয়া শকুন্তলাকে কহিলেন, সখি শকুন্তলা ! বোধ করি তাতকন্ব আশ্রয়পাদপদিগকে তোমা অপেক্ষা অধিক ভালবাসেন ।" বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা গদ্য সাহিত্য পরিনত ও শিল্পসমৃদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে । এরপর বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে গদ্যের চরম সার্থকতা লাভ করে ।
প্রথমদিকে গদ্য সাহিত্যে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বেশি ছিল, সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার ও বেশি ছিল । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর উত্তরসুরীদের সংস্কৃত শব্দের বদলে তদ্ভব, দেশী, বিদেশি শব্দের ব্যবহারের আধিক্য লক্ষ করা যায় । ভাষা আরও সহজ, সরল ও সহজবোধ্য হতে লাগল । সাধু ভাষার ওপর সংস্কৃতের যে ছায়া ছিল ক্রমশ তা সরে যেতে লাগল । সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার কমে গিয়ে 'দ্বারা', 'সহিত', 'অভ্যন্তরে', 'সমভিব্যবহারে' ইত্যাদির স্থান নিল 'দিয়ে', 'ভিতরে', 'সঙ্গে' ইত্যাদি অনুসর্গ । অনেক ক্ষেত্রে যৌগিক ক্রিয়াপদ একটি ক্রিয়াপদে পরিণত হল । যেমন— গমন করা > যাওয়া, আহার করা > খাওয়া, শ্রবণ করা > শোনা ।
বাংলা চলিত ভাষার উন্মেষ পর্বে কেরীর 'কথোপকথনের' প্রকাশ (১৮০১) একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । তদানীন্তন কবিওয়ালাদের গানে চলিত ভাষার বাকস্পন্দ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে । যেমন— রাম বসুর একটি গান -
সাধ করে করেছিলাম দুর্জয় মান
শ্যামের তাস হল অপমান ।
শ্যামকে সাধলেন না ফিরে চাইলেন না
কথা কইলেন না রেখে মান । ।
উল্লিখিত উদাহরণে স্বরধ্বনির লোপ ও দ্বিমাত্রিকতার ওপর দূরত্ব নির্ভর করছে । এই স্বরধ্বনি লোপ ও দ্বিমাত্রিকতা বাংলা রাঢ়ী ভাষার বৈশিষ্ট্য । ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অর্থাৎ, দক্ষিণ রাঢ়ীর পূর্বাংশের উপভাষা তথা কলকাতার কথ্য ভাষা অবলম্বন করে মান্য চলিত বাংলার উদ্ভব ও বিকাশ । এখন সাধু ও চলিত এই দুই লেখ্য রীতির পার্থক্য অনুধাবন করা যাক ।
চলিত ভাষার বিবর্তন — বাংলা চলিত ভাষা সম্পর্কে ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন "ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের অর্থাৎ দক্ষিণ রাঢ়ের পূর্ব অংশের তথা কলিকাতার কথ্য ভাষার পদ ও ইডিয়ম মূলধন করিয়া আধুনিককালের সাহিত্যের এবং ভদ্র ব্যবহারের প্রধান ভাষাছাঁদ চলিত ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়াছে ।" কিন্তু সাহিত্যের দরবারে চলিত ভাষার প্রবেশাধিকার অনেক পরে ঘটেছে । প্যারীচাঁদ মিত্রের "আলালের ঘরের দুলাল" বা কালীপ্রসন্ন সিংহের "হুতোম প্যাঁচার নকশা" গ্রন্থদুটি চলিত ভাষায় লেখা হলেও পুরোপুরি চলিত ভাষায় রচিত হয়নি । সাধু-চলিত মিশ্রিত একটি মিশ্র ভাষায় রচিত । তবে এই বইগুলোর ভাষায় সুরুচির সীমা অতিক্রম করে গেছে । উন্নতমানের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে চলিত ভাষাকে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তাঁর "য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র" নামক বইটি চলিত ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে । রবীন্দ্রনাথের উক্ত বইটি প্রকাশের পর চলিত ভাষা বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সমাদরে গৃহীত হয় ।
শব্দগত পার্থক্য: অনেকে সাধু ও চলিতে শব্দগত পার্থক্যের ওপর জোর দেন । আমাদের মনে হয় শব্দগত পার্থক্য দিয়ে এই দুই রীতির পার্থক্য চিহ্নিত করার চেষ্টা বৃথা । যাঁরা মনে করেন, চলিত ভাষায় আভিধানিক শব্দ বা তৎসম শব্দের ব্যবহার সাধু ভাষার তুলনায় কম, তাঁরা তথ্য বিচার না করেই একথা বলেন । দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ থেকে চলিত ভাষায় লেখা প্রবন্ধ থেকে যে কোনো একটা অংশ উদ্ধৃত করতে পারি— 'মানুষের চরিত্রে এমন কতগুলি বিরোধ আছে যে তার বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণীর চেষ্টাও বিড়ম্বনা এবং হয়তো উক্ত বিসংবাদের অনুগ্রহেই কোপার্নিকাস যে যুগে পৃথিবীর অহংকার ঘুচিয়ে তাকে সূর্যের আজ্ঞাচক্রে আনলেন, ঠিক সেই সময় মনুষ্য ধর্মের আকস্মিক স্ফূর্তি ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপের সর্বত্র ।'
এখন তৎসম শব্দ গুনে গুনে আমরা যদি দেখি তবে এই উদ্ধৃত অংশে যে পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসবে তার চলিত ভাষা সম্পর্কে আমাদের প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে বিচলিত করবে অবশ্যই । বরং এর তুলনায় সাধু ভাষায় লেখা 'গোরা'য় তৎসম শব্দের প্রাচুর্য কম ।
ধ্বনিগত পার্থক্য :- মৌখিক উচ্চারণ চলিত ভাষার রীতি হলেও এর লিখিত রূপে প্রায়শই মৌখিক উচ্চারণ রক্ষিত হয় না । অবশ্য দ্বিমাত্রিকতা রাঢ় উপভাষার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য । ভাষাচার্য সুনীতিকুমার 'ODBL' গ্রন্থে বাংলা ভাষার এই বৈশিষ্ট্যটি সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেন । যেমন বাদলা (badola) চলিত উচ্চারণে বাদলা (badla), গামোছা (gamocha) চলিত বাংলায় গামছা (gamcha)
রুপগত পার্থক্য :- সাধু ও চলিতের পার্থক্য আসলে রূপ-তাত্ত্বিক পার্থক্য । কয়েকটি সর্বনামের ও ক্রিয়াপদের কয়েকটি কালের রূপ দুই রীতিতে পৃথক । তবে এক রীতির রূপকে অন্য রীতিতে খুব সহজেই পরিবর্তিত করা চলে । এদের যদি তালিকাবদ্ধ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে এই পার্থক্য নিচের মতো যেমন— ডঃ শিশির দাশ দেখিয়েছেন,
সর্বনাম | |||||
সাধু | তাহা | কাহা | যাহা | ইহা | উহা |
চলিত | তা | কা | যা | এ | ও |
ক্রিয়াপদ | |||||
নিত্য অতীত | নিত্যবৃত্ত অতীত | ভবিষ্যৎ | ঘটমান | অসমাপিকা | |
সাধু | -ইল | -ইত | -ইব | -ইতেছে | -ইয়া, -ইতে, -ইলে |
চলিত | -ল | -ত | -ব | -ছ | -এ, -তে, -লে |
এই তালিকা থেকে বোঝা যায় সর্বনামের এই পাঁচটি রূপ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সাধু ও চলিতের কোনো পার্থক্য নেই । আর ক্রিয়া পদের নিত্য বর্তমানের দুই রীতিতে কোনো পার্থক্য নেই ।
পদান্বয়গত পার্থক্য :- পদান্বয় বা, syntan -এর ওপর একালের ভাষাতত্বে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপিত হয় । পদান্বয়ে সাধু ভাষা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ক্রম বজায় রাখে । বাংলা বাক্যে এই পদক্রমটি 'S-O-V' অর্থাৎ বাক্যের প্রথমে উদ্দেশ্য (Subject), পরে কর্ম (Object) ও বাক্যের শেষে ক্রিয়া (Verb) চলিতে এই নির্ধারিত ক্রম বজায় রাখতেই হবে এমন কোনো কথা নেই । যেমন— রামানন্দ পেলেন গুরুর পদ ক্রিয়াপদ অনুক্ত রাখাও চলিত রচনা রীতির একটি বৈশিষ্ট্য । ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর 'আলালের ঘরের দুলাল' শীর্ষক গ্রন্থটিতে সাধুভাষার সঙ্গে চলিত ভাষারও সাবলীল ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলিত ভাষাকে সাধু ভাষার সমপর্যায়ী শিল্প সার্থকতা দান করেন । অতঃপর শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের সাধু গদ্য ও মান্য চলিত ভাষার কাছকাছি চলে আসে । যেমন—
(ক) জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না । শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের বিনিময় —জীবন দেবতার এই রীতি । (পুতুল নাচের ইতিকথা)
(খ) ধীর সঞ্চারিত নৈশব্দের মধ্য দিয়া একটা হিম রহস্য সমস্ত সৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে । (কবি)
(গ) মধ্যে মধ্যে মৃত্যু ছলনা করে যায় মানুষকে, আস্তে আস্তে ফিরে যায়, ধরা দিতে দিতে দেয় না । (আরোগ্য নিকেতন)
তিনটি উদাহরণে দেখা যাচ্ছে সাধু ভাষা ('ক' ও 'খ') ও চলিত ভাষার (গ) বিপ্রতীপতা যেন আর থাকছে না ।
একদা ভাবা হত, সাধু ভাষায় আছে চিরকালের গাম্ভীর্য আর চলিত ভাষায় চলতিকালের চঞ্চলতা । কিন্তু শৈলীগত এই পার্থক্য আজ আর মানা হয় না । কারন চলিত ভাষায় শুধু চঞ্চলতা নয়, লেখকের কলমে হিমালয়ের গাম্ভীর্যও ধরা দেয় ।