অভিষেক — মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কনক-আসন ত্যজি, বীরেন্দ্রকেশরী
ইন্দ্রজিৎ, প্রণমিয়া ধাত্রীর চরণে,
কহিলা, — "কি হেতু, মাতঃ, গতি তব আজি
এ ভবনে ? কহ দাসে লঙ্কার কুশল ।"
শিরঃ চুম্বি, ছদ্মবেশী অম্বুরাশি-সুতা
উত্তরিলা; — "হায় ! পুত্র, কি আর কহিব
কনক-লঙ্কার দশা ! ঘোরতর রণে
হত প্রিয় ভাই তব বীরবাহু বলী !
তার শোকে মহাশোকী রাক্ষসাধিপতি,
সসৈন্যে সাজেন আজি যুঝিতে আপনি ।"
জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া; —
"কি কহিলা, ভগবতি ? কে বধিল কবে
প্রিয়ানুজে ? নিশা-রণে সংহারিনু আমি
রঘুবরে ; খন্ড খন্ড করিয়া কাটিনু
বরষি প্রচণ্ড শর বৈরিদলে ; তবে
এ বারতা, এ অদ্ভুত বারতা, জননী
কোথায় পাইলে তুমি, শীঘ্র কহ দাসে ।"
রত্নাকর রত্নোত্তমা ইন্দিরা সুন্দরী
উত্তরিলা; — "হায় ! পুত্র, মায়াবী মানব
সীতাপতি ; তব শরে মরিয়া বাঁচিল ।
যাও তুমি ত্বরা করি ; রক্ষ রক্ষঃকুল-
মান, এ কালসমরে, রক্ষঃ- চূড়ামণি !
ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী
মেঘনাথ; ফেলাইলা কনক বলয়
দূরে; পদ-তলে পড়ি শোভিল কুণ্ডল,
যথা অশোকের ফুল অশোকের তলে
আভাময় ! "ধিক মোরে" কহিলা গম্ভীরে
কুমার , "হা ধিক মোরে ! বৈরিদল বেড়ে
স্বর্ণলঙ্কা, হেথা আমি বামাদল মাঝে ?
এই কি সাজে আমারে, দশাননাত্মজ
আমি ইন্দ্রজিৎ, আন রথ ত্বরা করি ;
ঘুচাব ও অপবাদ, বধি রিপুকুলে ।"
সাজিলা রথীন্দ্রর্ষভ বীর অভরণে
হৈমবতীসুত যথা নাশিতে তারকে
মহাসুর; কিম্বা যথা বৃহন্নলারূপী
কিরীটি, বিরাটপুত্র সহ, উদ্ধারিতে,
গোধন, সাজিলা শূর, শমীবৃক্ষমূলে ।
মেঘবর্ণ রথ ; চক্র বিজলীর ছটা ;
ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী ; তুরঙ্গম বেগে
আশুগতি । রথে চড়ে বীর-চূড়ামণি
বীরদর্পে, হেন কালে প্রমিলা সুন্দরী,
ধরি পতি-কর-যুগ ( হায় রে, যেমতি
হেমলতা আলিঙ্গয়ে তরু-কুলেশ্বরে )
কহিলা কাঁদিয়া ধনী; "কোথা প্রাণসখে,
রাখি এ দাসীরে, কহ চলিলা আপনি ?
কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে
এ অভাগী ? হায়, নাথ গহন কাননে,
ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি
তার রঙ্গরসে মনঃ না দিয়া, মাতঙ্গ
যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রমে
যুথনাথ । তবে কেন তুমি, গুণনিধি,
ত্যজ কিকিঙ্করীরে আজি ?" হাসি উত্তরিলা
মেঘনাথ, "ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতি,
বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে ? ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া
কল্যাণী, সমরে নাশি তোমার কল্যাণে
রাঘবে । বিদায় এবে দেহ, বিধুমুখী ।"
উঠিল পবন-পথে, ঘোরতর রবে,
রথবর, হৈমপাখা বিস্তারিয়া যেন
উড়িলা মৈনাক-শৈল, অম্বর উজলি !
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে, টঙ্কারিলা ধনুঃ
বীরেন্দ্র, পক্ষীন্দ্র যথা নাদে মেঘ মাঝে
ভৈরবে । কাঁপিলা লঙ্কা, কাঁপিলা জলধি !
সাজিছে রাবণরাজা, বীরমদে মাতি; —
বাজিছে রণ-বাজনা; গরজিছে গজ;
হ্রেষে অশ্ব; হুঙ্কারিছে পদাতিক রথী;
উড়িছে কৌশিক-ধ্বজ; উঠিছে আকাশে
কাঞ্চন-কঞ্চুক-বিভা । হেন কালে তথা
দ্রুতগতি উতরিলা মেঘনাদ রথী ।
নাদিলা কর্বূরদল হেরি বীরবরে
মহাগর্বে । নমি পুত্র পিতার চরণে,
করজোড়ে কহিলা;—" হে রক্ষঃ-কুল-পতি,
শুনেছি, মরিয়া নাকি বাঁচিয়াছে পুনঃ
রাঘব ? এ মায়া, পিতঃ, বুঝিতে না পারি !
কিন্তু অনুমতি দেহ; সমূলে নির্মূল
করিব পামরে আজি ! ঘোর শরানলে
করি ভস্ম, বায়ু-অস্ত্রে উড়াইব তারে;
নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজপদে ।"
আলিঙ্গি কুমারে , চুম্বি শিরঃ, মৃদুস্বরে
উত্তর করিলা তবে স্বর্ণ-লঙ্কাপতি;
"রাক্ষস-কুল-শেখর তুমি, বৎস; তুমি
রাক্ষস-কুল-ভরসা । এ কাল সমরে,
নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা
বারংবার । হায়, বিধি বাম মম প্রতি ।
কে কবে শুনেছে পুত্র, ভাসে শিলা জলে,
কে কবে শুনেছে, লোক মরি পুনঃ বাঁচে ?"
উত্তরিলা বীরদর্পে অসুরারি-রিপু ;—
" কি ছার সে নর, তারে ডরাও আপনি,
রাজেন্দ্র ? থাকিতে দাস, যদি যাও রণে
তুমি, এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে ।
হাসিবে মেঘবাহন; রুষিবেন দেব
অগ্নি । দুই বার আমি হারানু রাঘবে;
আর এক বার পিতঃ, দেহ আজ্ঞা মোরে;
দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে !"
কহিলা রাক্ষসপতি; — "কুম্ভকর্ণ বলী
ভাই মম,— তায় আমি জাগানু অকালে
ভয়ে; হায়, দেহ তার, দেখ, সিন্ধু তীরে
ভুপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা
বজ্রাঘাতে ! তবে যদি একান্ত সমরে
ইচ্ছা তব, বৎস, আগে পূজ ইষ্টদেবে,—
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর, বীরমণি !
সেনাপতি-পদে আমি বরিণু তোমারে ।
দেখ, অস্তাচলগামী দিননাথ এবে;
প্রভাতে যুঝিও, বৎস, রাঘবের সাথে ।"
এতেক কহিয়া রাজা, যথাবিধি লয়ে
গঙ্গোদক, অভিষেক করিলা কুমারে ।
****