বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব (Effects of Global Warming) : মানুষের বিভিন্ন প্রকার অবিবেচনাপ্রসূত ক্রিয়াকলাপ, যেমন— অত্যধিক পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন, নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন ও অরণ্যবিনাশ, কৃষিকাজে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন জাতীয় সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে চলেছে এবং তার ফলস্বরূপ নিম্ন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । পৃথিবীর স্বাভাবিক উষ্ণতা অপেক্ষা এরূপ ক্রমবর্ধমান ও অস্বাভাবিক উষ্ণতা বৃদ্ধিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলা হয় । বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী । যেমন —
(১) মেরু অঞ্চলের বরফের গলন ও পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের গলন : ভূমণ্ডলের গড় উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মেরু অঞ্চলের বরফের স্তর ও পার্বত্য অঞ্চলের হিমবাহের গলন ঘটবে ও সমুদ্র জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে । ফলস্বরূপ সমুদ্র উপকূলভাগের নীচু অংশ জলমগ্ন হবে, উপকূলবর্তী অঞ্চলের মাটি লবণাক্ত ও অনুর্বর হয়ে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং সমগ্র সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হবে ।
(২) সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের জলের যোগান বৃদ্ধি পাবে ও সমুদ্র জলপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে । বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ১° সে. বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র জলতলের উচ্চতা প্রায় ১০ থেকে ১৫ সেমি. বৃদ্ধি পেয়েছে । এর ফলে পৃথিবীর নিম্ন উপকূল অঞ্চলসমূহ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতাসম্পন্ন দ্বীপগুলি সমুদ্রজলে নিমজ্জিত হবে ।
(৩) অধঃক্ষেপণের প্রকৃতির পরিবর্তন : বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফলে আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে উঠবে । ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পাবে ও ভৌমজলের ভাণ্ডারে টান পড়বে । এইভাবে অধঃক্ষেপণের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটবে ও সমগ্র বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হবে ।
(৪) শস্য উৎপাদনের বৈষম্য : বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বৃষ্টিপাতের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটবে, বৃষ্টিপাতের বন্টনেও চরম অসাম্য দেখা দেবে । ফলে কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাবে । অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি দীর্ঘায়িত হয়ে কৃষিজ ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে ।
(৫) কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তন : ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বায়ুমণ্ডল শুষ্ক হয়ে অনাবৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে । ফলে বৃষ্টিপাতনির্ভর কৃষি এলাকাগুলিতে সেচব্যবস্থানির্ভর চাষবাস শুরু হবে । আর্দ্র কৃষি প্রণালীর পরিবর্তে পৃথিবীব্যাপী শুষ্ক কৃষি ও মিশ্র কৃষি পদ্ধতির প্রসার ঘটবে ।
(৬) এল নিনো সৃষ্টি ও পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব : স্পেনীয় শব্দ 'El Nino' কথার অর্থ Christ Child বা শিশু খ্রীষ্ট । বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বভাগে পেরু ও ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল দিয়ে কোনো কোনো বছর খ্রিষ্টমাসের সময় প্রচন্ড উষ্ণ সমুদ্রস্রোত প্রবাহের ফলে আবহাওয়ার যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে, তাকে এল নিনো বলা হয় । এল নিনোর প্রভাবে, (i) পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে । ফলে খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হয় । (ii) পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের উষ্ণতা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায় । (iii) দক্ষিণ আমেরিকার পেরু উপকূলে সামুদ্রিক মৎস্যের আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
(৭) পৃথিবীতে আগত ও বিকিরিত তাপের বৈষম্য : বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীতে আগত সূর্যরশ্মি ও পৃথিবী থেকে বিকিরিত সৌরতাপ শক্তির পরিমাণের মধ্যে বৈষম্য ঘটে । ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাজেটের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় । ফলে খরা ও বন্যা, ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলের প্রকোপ বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে ভয়ংকর টর্নেডো ঘূর্নিঝড় এবং অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের প্রাদুর্ভাব বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
লা নিনা কী ? স্পেনীয় শব্দ 'La Nina' কথার অর্থ হল 'ক্ষুদ্র বালিকা' । প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৪° সে. কমে গেলে দক্ষিণ আমেরিকা পেরু, ইকুয়েডর উপকূল বরাবর কোনো কোনো বছর যে অতি শীতল সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, তাকে লা-নিনা বলে । প্রভাবে ভারতে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয় ।
****