জৈবিক আবহবিকার ও মাটির উৎপত্তি (Organic Weathering and Formation of Soil)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 05/15/2012 - 09:53

জৈবিক আবহবিকার (Organic Weathering):- জৈবিক আবহবিকার হল যান্ত্রিক আবহবিকার [Mechanical Weathering] -এর একটি বিশেষ রূপ । গাছপালার শিকড় শিলাস্তরের মধ্যে ঢুকে ফাটল ধরিয়ে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটায় । যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকার ছাড়াও উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিলাখন্ডকে চূর্ণ বিচুর্ণ করে থাকে । ইঁদুর, খরগোশ, প্রেইরি কুকুর, পিঁপড়ে, কেঁচো, উই প্রভৃতি মৃৎভেদী প্রাণীরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ভেতরের শিলাচূর্ণ, মাটি ইত্যাদি উপরের পৃষ্ঠে নিয়ে আসে । এভাবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিলাখন্ডকে চূর্ণবিচূর্ণ করে থাকে । এরকম আবহবিকার কে জৈবিক আবহবিকার বলে ।

জৈবিক আবহবিকার -এর সংঘটন:- জৈবিক বিচূর্ণীভবন বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সাহায্যে হতে পারে ।

উদ্ভিদের সাহায্যে বিচূর্ণীভবন:-

১) উদ্ভিদ, লতাপাতা প্রভৃতি জলে পচে যে জৈব অম্লের সৃষ্টি হয় তার সংস্পর্শে এলে শিলাগঠিত খনিজে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, ফলে কালক্রমে খনিজ বিয়োজিত হয়ে শিলা ক্ষয়িত হয়;

২) এছাড়াও শিলার ফাটল দিয়ে উদ্ভিদের শিকড় শিলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিস্তার লাভ করে এবং শিলাকে চূর্ণবিচূর্ণ হতে সাহায্য করে ।

প্রাণীর সাহায্যে বিচূর্ণীভবন:-

১) প্রেইরি কুকুর, খরগোশ, ছুঁচো, ইঁদুর, কেঁচো প্রভৃতি মৃৎভেদী প্রাণী ভূপৃষ্ঠে গর্ত করে বাসস্থান নির্মান করতে গিয়ে মৃত্তিকার দৃঢ়তা নষ্ট করে একে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে সাহায্য করে ।

২) বিভিন্ন ধরনের কীট, জীবাণু এবং ব্যাকটিরিয়ার দেহ-নিঃসৃত রসের মাধ্যমে শিলায় আবহবিকার [Weathering] হয় ।

মাটির সৃষ্টি (Formation of Soil):- ভূত্বকের উপরিভাগের ক্ষয়ে যাওয়া শিলাচূর্ণের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জৈব্য ও অজৈব বস্তুর সংমিশ্রণে গঠিত যে নরম ও অসমসত্ত্ব আবরণ স্তরে গাছপালা জন্মায়, তাকেই মাটি [ Soil ]বলে।

মাটির উৎপত্তি :-  ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পৃথিবী প্রথমে গ্যাসীয় বা বায়বীয় অবস্থায় ছিল । পরে তাপ বিকিরণের ফলে পৃথিবী তরল অবস্থায় আসে এবং ক্রমাগত তাপ বিকিরণের ফলে ঠান্ডা হয়ে শক্ত পিণ্ডে পরিণত হয় । এই শক্ত পিণ্ডকে শিলা বলে । কঠিন শিলা প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক বিক্রিয়ায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অবশেষে মাটিতে পরিণত হয় । আসলে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া শিলার সঙ্গে জৈব পদার্থ মিশ্রিত হয়েই প্রকৃত মাটি সৃষ্টি হয় । ভূ-পৃষ্ঠে মাটি সৃষ্টির পদ্ধতিগুলিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা- (i)  প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া,  (ii) জৈব প্রক্রিয়া (উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা) ।

(i) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া:- যেসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মাটি সৃষ্টি হয় সেগুলি হল- (ক) আবহবিকার, (খ) ক্ষয়ীভবন, (গ) নগ্নীভবন, (ঘ) অপসারণ এবং  (ঙ) অবক্ষেপন ।

(ক) আবহবিকার:  শীতের প্রচন্ড শৈত্য, গ্রীষ্মের উত্তাপ এবং দিন ও রাতের উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য ভূপৃষ্ঠের শিলার ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণ হয় । সাধারণ ভাবে একে আবহবিকার বলে । আর এই আবহবিকারের ফলে শিলাত্বকে ফাটল ধরে এবং শিলার ওপরের অংশ ক্রমশ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে । কালক্রমে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক (Organic), রাসায়নিক (Chemical) এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূর্ণবিচূর্ণ উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে ।

(খ) ক্ষয়ীভবন:- বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, জলস্রোত, হিমবাহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে কিংবা আবহবিকারের জন্য ভূত্বকের উপরিভাগ ক্রমশ ক্ষয় পেয়ে মাটির সৃষ্টি করে । এই প্রক্রিয়াকে ক্ষয়ীভবন বলে ।

(গ) নগ্নিভবন:- বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা ভূত্বকের উপরিভাগ চূর্ণবিচূর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হলে শিলার ওপরের অংশ আলগা হয়ে যাওয়ায় ঠিক তার নীচের স্তরটি উন্মুক্ত বা নগ্ন হয়ে পড়ে, এই প্রক্রিয়াকে নগ্নীভবন বলে ।

(ঘ) অপসারণ:- এই প্রক্রিয়ায় ভূত্বকের উপরিভাগের চূর্ণবিচূর্ণ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি প্রাকৃতিক বাহক, যথা-  জলস্রোত, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ ইত্যাদির দ্বারা একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবাহিত হয় এবং কালক্রমে সঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক [Organic], রাসায়নিক [Chemical] এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূর্ণবিচূর্ণ উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে । 

(ঙ) অবক্ষেপণ: এই প্রক্রিয়ায় ভূত্বকের উপরিভাগের চূর্ণবিচূর্ণ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি পরিবাহিত হয়ে অন্য কোনও স্থানে সঞ্চিত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে ।

(ii) জৈবিক প্রক্রিয়া:- উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা মাটির উৎপত্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে ।

(ক) ছোটো বড়ো উদ্ভিদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে ।

(খ) উদ্ভিদ, লতাপাতা প্রভৃতি জলে পচে যে জৈব অম্লের সৃষ্টি হয় তার সংস্পর্শে এলে শিলাগঠিত খনিজে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, ফলে কালক্রমে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে । 

(গ) শিলার ফাটলের মধ্যে উদ্ভিদের মূল প্রবেশ করলে ফাটলের আয়তন বাড়ে এবং উদ্ভিদের মূলের বৃদ্ধির ফলে শিলা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় ।

(ঘ) শিলার ওপর শৈবাল, ছত্রাক ইত্যদি জন্মালে শিলা নরম ও আলগা হয়ে মাটিতে পরিণত হয় ।

(ঙ) মাটিতে থাকা বিভিন্ন জীবাণু, মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহকে পচিয়ে জৈব পদার্থে পরিণত করে এবং পরোক্ষভাবে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে ।

(চ) মাটিতে বসবাসকারী কেঁচো, উঁই, পিঁপড়ে, ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণীরা মাটিকে ওলটপালট করে দিয়ে রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে জৈব উপাদানের মিশ্রণ ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে ।

রেগোলিথ (Regolith) :- রেগোলিথ হল মৃত্তিকাময় এক ধরনের শিথিল শিলাচূর্ণ । মাটি সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থাকে রেগোলিথক বলা যেতে পারে । আবহবিকারের ফলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর ক্রমাগত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অবশেষে ছোট ছোট সূক্ষ্ম কণায় পরিণত হয় এবং ভূত্বকের উপর রেগোলিথ নামে এক ধরনের শিলাচূর্ণের আবরণ পড়ে ।  কালক্রমে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক, রাসায়নিক এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেগোলিথের প্রাথমিক উপাদান গুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে । সাধারণত গ্রানাইট শিলায় আবহবিকারের ফলে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু অঞ্চলে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সুরকির মতো এক ধরনের মৃত্তিকাময় ও লাল রঙের শিথিল শিলাচূর্ণ রেগোলিথ সৃষ্টি করে ।      

মাটির শ্রেণিবিভাগ:-

উৎপত্তি অনুসারে মাটি দু’ধরনের হয়, যেমন- (১) স্থানীয় মাটি ও  (২) অপসৃত মাটি ।

(১) স্থানীয় মাটি:- প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে মাতৃশিলা থেকে উৎপন্ন মাটি উৎপত্তিস্থলেই স্থিতিলাভ করে তখন তাকে স্থানীয় মাটি বা স্থিতিশীল মাটি বলে । এই ধরনের মাটির ওপরের স্তরএর কণাগুলো সূক্ষ্ম হয় কিন্তু নীচের স্তরগুলিতে মাটির কণাগুলো ক্রমশ মোটা হতে শুরু করলেও মাটির বিভিন্ন স্তরের মূল উপাদান একই থাকে ।

(২) অপসৃত মাটি:- যেসব মাটি বায়ুপ্রবাহ, তুষারপাত, জলপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা পরিবাহিত হয়ে তাদের উৎস থেকে দূরবর্তী স্থানে সঞ্চিত হয়, তাদের পরিবাহিত বা অপসৃত মাটি বলে । অপসৃত মাটি সাধারণত উর্বর হয় এবং দূরবর্তী স্থান থেকে আসার জন্য অপসৃত মাটির মূল ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের নীচে থাকা শিলাস্তর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয় ।

মাটির প্রকারভেদ : অপসৃত মাটি নানা ধরনের হতে পারে, যেমন- কোনো স্থানের মাটি বায়ুপ্রবাহ দ্বারা পরিবাহিত হয়ে দূরবর্তী স্থানে সঞ্চিত হলে তাকে লোয়েস মাটি এবং জলপ্রবাহ দ্বারা সঞ্চিত হলে তাকে পলিমাটি বলে ।

গঠন অনুসারে মাটির শ্রেণিবিভাগ:- গঠন অনুসারে মাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথা:-

(i) দোঁয়াশ মাটি,  —এই মাটিতে বালি ও কাদা প্রায় সমপরিমাণে থাকে,

(ii) এঁটেল মাটি —এই মাটিতে কাদার ভাগ বেশি

(iii) বেলে মাটি — এই মাটিতে বালির ভাগ বেশি ।   

*****

Related Items

কাবেরী নদী (The Kaveri)

কাবেরী নদী (The Kaveri) : কর্ণাটক রাজ্যের তালাকাভেরি উচ্চভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে কাবেরী নদী কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্য দিয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । কাবেরী নদীর দৈর্ঘ্য ৭৬৫ কিমি.

কৃষ্ণা নদী (The Krishna)

কৃষ্ণা নদী (The Krishna) : পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মহাবালেশ্বরের শৃঙ্গের কিছুটা উত্তরে প্রায় ১৪০০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর কৃষ্ণা নদী দক্ষিণ-পূর্বে তেলেঙ্গানা ও অন্ধপ্রদেশ রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিশাল বদ্বীপ সৃষ্টি করে

গোদাবরী নদী (The Godavari)

গোদাবরী নদী (The Godavari) : গোদাবরী নদী 'দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা' নামে পরিচিত । মহারাষ্ট্রের ব্রম্ভগিরি পাহাড়ের ত্র্যম্বক শৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে এবং পরে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে গোদাবরী নদী মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ

মহানদী (The Mahanadi)

মহানদী (The Mahanadi) : ছত্তিসগড় রাজ্যের রায়পুর জেলার দক্ষিণাংশের সিয়াওয়া মালভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা রাজ্য অতিক্রম করার পর বদ্বীপ সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে । মহানদী

তাপী নদী (The Tapti)

তাপী বা তাপ্তি নদী (The Tapti) : মধ্যপ্রদেশের মহাদেব পর্বতের মুলতাই উচ্চভূমির প্রায় ৭৭০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হয়ে তাপী নদী মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে সাতপুরা ও অজন্তার মধ্যবর্তী সংকীর্ণ উপত