আমরা — সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
**************************
মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে
আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থে–বরদ বঙ্গে;—
বাম হাতে যার কমলার ফুল, ডাহিনে মধুক-মালা,
ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভুবন আলা,
কোল-ভরা যার কনক ধান্য, বুক-ভরা যার স্নেহ,
চরণে পদ্ম, অতসী অপরাজিতায় ভূষিত দেহ,
সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে, —
আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গ ।
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি ।
আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে,
দশানন জয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে ।
আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয় ।
একহাতে মোরা মগেরে রুখেছি, মোগলেরে আর-হাতে,
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লিনাথে ।
জ্ঞানের নিধান আদিবিদ্বান কপিল সাঙ্খ্যকার
এই বাংলার মাটিতে গাঁথিল সূত্রে হীরক-হার ।
বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর,
জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপঙ্কর ।
কিশোর বয়সে পক্ষধরের পক্ষশাতন করি'
বাঙালির ছেলে ফিরে এল দেশে যশের মুকুট পরি' ।
বাংলার রবি জয়দেব কবি কান্ত কোমল পদে
করেছে সুরভি সংস্কৃতের কাঞ্চন-কোকনদে ।
স্থপতি মোদের স্থাপনা করেছে 'বরভূধরের' ভিত্তি,
শ্যাম-কম্বোজে 'ওঙ্কার-ধাম',— মোদেরি প্রাচীন কীর্তি ।
ধেয়ানের ধনে মূর্তি দিয়েছে আমাদের ভাস্কর
বিটপাল আর ধীমান—যাদের নাম অবিনশ্বর ।
আমাদেরি কোন সুপটু পটুয়া লীলায়িত তুলিকায়
আমাদের পট অক্ষয় করে রেখেছে অজন্তায় ।
কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি'
মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি ।
মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি,
বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশিসে অমৃতের টিকা পরি' ।
দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
আমাদেরি এই কুটিরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি;
ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া,
বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া ।
বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়, —
বাঙালির ছেলে ব্যাঘ্রে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয় ।
তপের প্রভাবে বাঙালি সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া,
আমাদের এই নবীন সাধনা শব-সাধনার বাড়া ।
বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়েছে বিয়া,
মোদের নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া ।
বাঙালির কবি গাহিছে জগতে মহামিলনের গান,
বিফল নহে এ বাঙালি জনম বিফল নহে এ প্রাণ ।
ভবিষ্যতের পানে মোরা চাই আশা-ভরা আহ্লাদে,
বিধাতার কাজ সাধিবে বাঙালি ধাতার আশীর্বাদে ।
বেতালের মুখে প্রশ্ন যে ছিল আমরা নিয়েছি কেড়ে,
জবাব দিয়েছি জগতের আগে ভাবনা ও ভয় ছেড়ে;
বাঁচিয়া গিয়েছি সত্যের লাগি' সর্ব কোরিয়া পণ,
সত্যে প্রণমি থেমেছে মনের অকারণ স্পন্দন ।
সাধনা ফেলেছে, প্রাণ পাওয়া গেছে জগৎ-প্রাণের হাটে,
সাগরের হাওয়া নিয়ে নিশ্বাসে গম্ভীরা নিশি কাটে;
শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী,
তাহারি ছায়ায় আমরা মিলাব জগতের শতকোটি ।
মণি অতুলন ছিল যে গোপন সৃজনের শতদলে, —
ভবিষ্যতের অমর সে বীজ আমাদেরি করতালে;
অতীতে যাহার হয়েছে সূচনা সে ঘটনা হবে হবে,
বিধাতার বরে ভরিবে ভুবন বাঙালির গৌরবে ।
প্রতিভায় তপে সে ঘটনা হবে, লাগিবে না তার বেশি,
লাগিবে না তাহে বাহুবল কিবা জাগিবে না দ্বেষাদ্বেষি;
মিলনের মহামন্ত্রে মানবে দীক্ষিত করি' ধীরে —
মুক্ত হইব দেব-ঋণে মোরা মুক্তবেণীর তীরে ।
*****