পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (Peasants' Revolt in Pabna) :- ১৯৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল্ বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা 'পাবনা বিদ্রোহ' নামে পরিচিত । পাবনার ইউসুফশাহী পরগনায় প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় । এই কৃষকবিদ্রোহের মূল কারণ ছিল— অতিরিক্ত খাজনা বৃদ্ধি ও জমিতে রায়তদের দখলিস্বত্ব হরণ । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও বারাণসীতে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের দশম আইনের প্রয়োগ দ্বারা জমিদাররা তিনটি কারণে জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারত । এগুলি হল—
(১) যদি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একই ধরনের জমির খাজনার তুলনায় রায়ত কম খাজনা প্রদান করে ।
(২) যদি উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায় ।
(৩) যদি রায়তরা তার জমির বরাদ্দ পরিমাণের চেয়ে কম পরিমাণ খাজনা দেয় ।
উপরোক্ত কারণগুলিতে জমিদাররা জমির খাজনা বৃদ্ধি করতে পারত । তবে জমিদাররা এইসব আইনের বাইরেও নানা ধরনের দুর্নীতি ও দমননীতির আশ্রয় নিয়ে জমির খাজনা বৃদ্ধি করত । পাবনা জেলার জমিদাররা কৃষকদের ওপর উপকর চাপিয়ে তা মূল খাজনার সঙ্গে যোগ করে আদায় করতে শুরু করে । স্বল্পদিনের জন্য রায়তদের সঙ্গে জমিদারদের লিজে জমি বন্দোবস্ত শুরু হয় । বিদ্রোহী কৃষকরা 'দি পাবনা রায়ত লিগ' গঠন করে জমিদারদের বেআইনি ভাবে চাপানো খাজনা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । লিগ কৃষকদের মামলা চালাতে সহায়তা করে ।
এই বিদ্রোহে স্থায়ী রায়তদের ভুস্বামী ঈশানচন্দ্র রায়, মেঘুল্লা গ্রামের মোড়ল শম্ভুনাথ পাল, ক্ষুদিমোল্লা প্রমুখদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বাড়তি খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং জমিদারদের কাছে স্বাক্ষরিত কবুলিয়ত পত্রগুলি পুড়িয়ে দেয় । ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্রোহ সমগ্র পাবনা জেলা-সহ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহি প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে । বিদ্রোহে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়ে ঈশানচন্দ্র 'বিদ্রোহী রাজা' নামে পরিচিত হন ।
পাবনা বিদ্রোহ মূলত জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ায় বিদ্রোহীরা মধ্যবিত্ত বাঙালিদের একাংশের সমর্থন পায়নি । এই পরিস্থিতে বিদ্রোহীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার ও ১৮৭৩-৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে পাবনা বিদ্রোহ দুর্বল হয়ে পড়ে ।
জমিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত পাবনা বিদ্রোহ সমকালীন অন্যান্য কৃষকবিদ্রোহগুলির মতো হিংসাত্মক রূপ নিয়েছিল । তবে নিহতের ঘটনা বিদ্রোহীদের হাতে খুব বেশি ঘটেনি ।
****