নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt) : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেলে মুনাফালোভী ইংরেজরা দাদনের জালে আবদ্ধ করে ছলে, বলে, কৌশলে দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করে, অন্যথায় চলে অকথ্য অত্যাচার, গৃহে আগুন, লুটপাট, শারীরিক নির্যাতন, চাবুক-শ্যামাচাঁদের ব্যবহার, স্ত্রী-কন্যার অপহরণ, লাঞ্ছনা, পুলিশি নির্যাতন, খাদ্যাভাব —যার প্রতিবাদে ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে অবিভক্ত বাংলায় নীলচাষিরা যে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে তা ইতিহাসে 'নীল বিদ্রোহ' নামে পরিচিত । ঊনিশ শতকে বাংলায় যে সকল কৃষকবিদ্রোহ হয়েছিল তার মধ্যে নীল বিদ্রোহ ছিল অন্যতম ।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন পাস হলে নীলচাষের ওপর ব্রিটিশ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার খর্ব হয় । ভারতের কৃষিজমি নীলচাষের উপযুক্ত হওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে নীলকররা ভারতে এসে নীলের লাভজনক ব্যবসা শুরু করে । আমেরিকা থেকেও ইংরেজ খেত মালিকরা ভারতে এসে নীলচাষ শুরু করে । বারাসত, যশোহর, নদিয়া, পাবনা, খুলনা, ঢাকা, রাজশাহি, মালদা, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ অঞ্চল নীলকুঠিতে ভরে যায় । নীলকর সাহেবরা মোটা টাকার বিনিময়ে জমিদারদের থেকে দীর্ঘ সময়ের ভিত্তিতে জমি ভাড়া করে তাতে নীলচাষ শুরু করে । প্রথমে নীলকররা ভাড়া করা চাষিদের দিয়ে নীলচাষ করাত, পরে তারা অধিক লাভের আশায় চাষিকে তার নিজের জমিতেই নীল চাষ করতে বাধ্য করে । নিজের মালিকানাধীন জমির নীলচাষ নিজ 'অবাদি বা এলাকা চাষ' এবং চাষির জমিতে নীলচাষ 'রায়তি', 'দাদনি' বা 'বে-এলাকা চাষ' নামে পরিচিত ছিল ।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীলকর সাহেবরা চাষিদের দাদন বা অগ্রিম দিয়ে নীল চাষ করাত । চাষিরা তাদের জমির একটা নির্দিষ্ট অংশে নীল চাষ করবে এবং উৎপন্ন ফসল নীলকরদের হাতে তুলে দেবে এই শর্তে দাদন দেওয়া হত । কৃষকরা এই ধরনের শর্ত না মানলে নীলকর ও তাদের কর্মচারী তাদের তা মানতে বাধ্য করত । চাষিদের ওপর নীলকুঠির লাঠিয়ালরা হামলা চালাত । চাষিদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত । চাষির পরিবারের স্ত্রী-কন্যাদের অপহরণ ও লাঞ্ছনা করা ছিল রোজকার ঘটনা । অশিক্ষিত অসহায় নীলচাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত নীল কেনার সময় ওজন বেশি নিয়ে কম দাম দিয়ে প্রতারণা করা হত । এভাবে নীলকররা নীল চাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাত, যা হল নীল বিদ্রোহের এক প্রধান কারণ ।
১৮৪২ সালের পর থেকে নীলের বাজারে মন্দা দেখা দেয় ও নীলের বাজারমূল্য পড়ে যাওয়ায় বহু নীলকর দেউলিয়া হয়ে যায় । নীলকরদের ব্যবসার পুঁজির প্রধান উৎস ইউনিয়ন ব্যাংক ১৮৪৭ সালে দেউলিয়া ঘোষিত হলে নীলকরদের পুঁজিতে টান পড়ে । এই অবস্থায় তারা চাষিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় । নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে নীলকররা কম দামে চাষিদের নীল চাষ করতে বাধ্য করেছিল । এছাড়া ঐ সময় বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও নীলের চেয়ে পাটের মত বেশি লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্যের প্রচলন নীল অর্থনীতিতে এক গভীর সংকটের সূত্রপাত হয় ।
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী চৌগাছা গ্রামে নীল বিদ্রোহ শুরু হয়ে নানা জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার নদিয়া, বারাসাত, যশোহর, পাবনা, রাজশাহি, মালদা, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলায় এই বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে । সর্বত্রই কৃষকেরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, তারা আর নীলের চাষ করতে রাজি নয় । প্রথমদিকে কৃষকরা কোনো সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়নি । তারা শান্তিপূর্ণ পথে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে তাদের অভাব-অভিযোগের প্রতিকার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ায় ও নীলকর সাহেবরা বলপ্রয়োগের চেষ্টা করায় বিদ্রোহ ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নেয় । লক্ষ লক্ষ নীলচাষি বর্শা, তরোয়াল, বাঁশের লাঠি ও ঢাল নিয়ে এই বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ে । নীলকুঠিগুলি আক্রমণ করে বিদ্রোহীরা সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয় । নীলের চারাগুলিকে উপড়ে ফেলে দিয়ে নীলচাষকে সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা করে ।
নীল বিদ্রোহে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একাংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । কৃষকদের সঙ্গে কিছু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের পূর্বতন কর্মচারীরা নীল বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল । মোরাদ বিশ্বাস নামে নীলকুঠির একজন প্রাক্তন কর্মচারী ঔরঙ্গাবাদের কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল । রামরতন, রামমোহন ও গিরীশ মল্লিক নামে তিন ভাই যশোহরের কৃষকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল । নীল বিদ্রোহের দুজন প্রভাবশালী নেতা নদিয়ার দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস একসময় নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন । অন্যদিকে গ্রামের জোতদার, তালুকদার ও কিছু মহাজনও নীল বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন । বিদ্রোহে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়ে নাড়াইলের জমিদার রামরতন মল্লিক 'বাংলার নানাসাহেব' নামে পরিচিত হন । বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনীকার শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসকে 'বাংলার ওয়াট টাইলার' আখ্যা দেন । পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের রফিক মন্ডল, খুলনার কাদের মোল্লা, সুন্দরবন এলাকার রহিমউল্লা, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডিপুরের জমিদারি শ্রীহরি রায় প্রমুখ এই বিদ্রোহের আরও কয়েকজন নেতা ছিলেন ।
অক্ষয়কুমার দত্তের 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা', হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকা, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের 'সংবাদ প্রভাকর' প্রভৃতি পত্রিকায় কৃষকদের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছিল । এছাড়াও শিশিরকুমার ঘোষ, হরিনাথ মজুমদার, মাথুরানাথ মৈত্র সোচ্চার হলেও সাহিত্যে প্রতিবাদের চরম প্রকাশ ঘটেছিল দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটকে । মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ও খ্রিস্টান মিশনারি রেভারেন্ড জেমস লঙ নিজ নামে প্রকাশ করেছিলেন । স্বার্থবিরোধী হওয়ায় লং সাহেবের নামে নীলকররা মামলা করে । মামলায় লং সাহেবের এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয় । জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ । নীলদর্পণ নাটক ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় এই নাটক অনূদিত হয় । 'নীলদর্পণ' নাটক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলে । এই নাটক বাঙালির মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় । 'নীলদর্পণ' নাটক মানুষের আবেগে কতটা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল তা একটি ঘটনা থেকে জানা যায় । নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সময় দর্শক আসনে বসে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অত্যাচারী নীলকর সাহেব মিস্টার উডের চরিত্রে অভিনয়কারী অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির দিকে জুতো ছুড়ে মেরেছিলেন । নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার ও নদীয়ার গুয়াতলির মিত্র পরিবারের বিপর্যয়ের কাহিনীকে ভিত্তি করে লেখা এই নাটকে তৎকালীন সমাজজীবনের অবস্থা, অনুভূতি, শাসন-শোষণ সংগ্রাম ও সম্প্রীতির চিত্র সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে । নীলবিদ্রোহ ছিল কৃষকদের মানসিক দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত, সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ ঐকবদ্ধ সংগ্রাম যা এই নাটকে সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । অসহায়, অত্যাচারিত কৃষকদের দুঃখদুর্দশা, নীলকরদের অত্যাচার, জমিদারদের এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সামাজিক মানসিকতা, পারস্পরিক কর্তব্যবোধ, পিতৃভক্তি, অপত্যস্নেহ, সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক মেলবন্ধন সবই এই 'নীলদর্পণ' নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'নীলদর্পণ' নাটককে হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র নাটক 'আংকেল টমস কেবিন' -এর সঙ্গে তুলনা করেছেন । প্রখ্যাত আইনজীবী শম্ভুনাথ পন্ডিত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও তিনু চক্রবর্তীর মতো কিছু আইনজীবী ছাড়া অধিকাংশ আইনজীবী নিজেদের স্বার্থে এবং যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে কৃষকদের সাহায্য করেছিলেন ।
নীল বিদ্রোহের তীব্রতায় ব্রিটিশ সরকার নড়েচড়ে বসে । বিদ্রোহের পর নীলকর সাহেবরা নীলকুঠিগুলি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় । নীলচাষিদের ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তৎকালীন বাংলার ছোটলাট জন পিটার গ্রান্ট ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ 'নীল কমিশন' গঠন করে । পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই নীল কমিশনের সদস্যগণ ছিলেন— সরকার পক্ষের সীটন কার এবং আর টেম্পল,পাদরিদের পক্ষে রেভারেন্ড সেল, নীলকর সমিতির পক্ষ থেকে ফার্গুসন এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় । অনুসন্ধানের পর কমিশন নীলচাষিদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নেয় । নীলচাষের উদ্দেশ্যে গৃহীত দাদনকে কেন্দ্র করে নীল কমিশন নীলচাষিদের দুঃখ-দুর্দশা এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ যথার্থ বলে মনে করে । ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের 'অষ্টম আইন' দ্বারা নীলচুক্তি আইন বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং জানায় যে নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষীদের ইচ্ছাধীন । এর ফলে নীলচাষিরা নীলকরদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায় । পরবর্তীকালে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদন শুরু হলে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায় ।
বৈশিষ্ট্য :- এই বিদ্রোহের কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় —
(১) এই বিদ্রোহ জমিদার-মহাজনবিরোধী কোনো আন্দোলন ছিল না । নীলকর সাহেবরা ছিল কৃষকদের মূল প্রতিপক্ষ । তাদের অকথ্য অত্যাচার ও জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল ।
(২) কৃষকরা শুধু জোরজবরদস্তি নীলচাষ বন্ধ করতে চায়নি, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত নীলচাষ প্রথার পুরোপুরি অবলুপ্তি ঘটানো । এই ধরনের বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন বাংলায় এর আগে ঘটেনি ।
(৩) এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৃষকরা মানসিক দৃঢ়তার যে বিরল দৃষ্টান্ত রেখেছিল, তা ইতিহাসে তুলনাহীন । তারা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল যে, তারা নীলচাষ করবে না । নীল কমিশনের সাক্ষ থেকে কৃষকদের এই মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় ।
(৪) নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়েছিল । কৃষকদের পাশাপাশি কিছু জমিদার, ব্যবসায়ী, তালুকদার, পত্তনিদার, নীলকর সাহেবদের পূর্বতন কর্মচারীরা এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল ।
(৫) এই বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ । এর পূর্ববর্তী ওয়াহাবি, ফরাজি ও সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের প্রভাব একটি প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কার্যকরী ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে তার অভাব স্পষ্ট ছিল । এই বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষকদের অধিকার রক্ষার বিদ্রোহ । এর সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ ছিল না ।
(৬) নীল বিদ্রোহে খ্রিস্টান মিশনারিরা বিদ্রোহীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল । তারা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল এবং এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।
******