সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি - তৃতীয় পর্যায়
Background of communal politics
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ভারতে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে আসছিলেন । এতে ইন্ধন যোগান ঊর্দু কবি মহম্মদ ইকবাল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলি । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ইকবাল 'অখন্ড ইসলাম তত্ত্ব' প্রচার করেছিলেন । ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ইকবালের প্রভাবপুষ্ট চৌধুরী রহমত আলি তাঁর 'এখান অথবা কখনও না' ইস্তাহারপত্রে পৃথক পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন । ইকবাল মুসলিমদের জাতীয় রাষ্ট্রের তত্ত্ব এবং রহমত আলি আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী সদস্যদের মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন । প্রথম প্রথম মুসলমান নেতৃবৃন্দ রহমত আলির এই প্রস্তাবকে উদ্ভট মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন । এমনকি স্বয়ং মহম্মদ ইকবাল এর সর্বনাশা পরিণামের কথা ভেবে এর নিন্দা করেছিলেন । তিনি কেবল ভারতে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় শিথিল যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছিলেন । সেখানে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে হিন্দু মুসলমানের পৃথক কর্তৃত্ব থাকলেও বৈদেশিক, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে যৌথ দায়িত্ব থাকবে । ইংরেজ সরকার আগাগোড়া ভারতে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বাড়িয়ে তোলার চেষ্টায় রত ছিলেন । পাকিস্তান প্রস্তাব তাঁদের প্রচেষ্টাকে সফল করার ইন্ধন যুগিয়ে দেয় । গোলটেবিল বৈঠকে জিন্না সহ অপরাপর মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দাবি করতে থাকেন । দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধিজির শত চেষ্টা সত্ত্বেও জিন্না তাঁর সাম্প্রদায়িক দাবিতে অটল থাকেন । মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন । নেহরু সংবিধান বানচাল হবার পর অনেক জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লিগে যোগদান করায় এই দলের শক্তি বৃদ্ধি হয় । ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার নীতি স্বীকৃত হওয়ায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ খুশি হয়েছিলেন । নতুন ভারত শাসন আইনের রূপরেখা অনুযায়ী সারা দেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ভারতে এগারোটি প্রদেশের মধ্যে সাতটিতে কংগ্রেস বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে । এই সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত নির্বাচন ক্ষেত্রগুলিতে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ গুলিতে মুসলিম লিগ বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছিল । নির্বাচনের পর মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে যুগ্মভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দিলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে । কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তে জিন্না প্রচন্ডভাবে অসন্তুষ্ট হন ।
এই পরিস্থিতিতে ভারতসচিব জেটল্যান্ড ঘোষণা করেন যে, ভারতে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান না হলে কোনো প্রকার সাংবিধানিক সংস্কার করা হবে না । ব্রিটিশ সরকারের এই আচরণে 'কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি' ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২২শে অক্টোবর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে কোনো প্রকার সাহায্য না করার সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে অক্টোবর থেকে ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশে সব প্রদেশের কংগ্রেস মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন । ফলে মহম্মদ আলি জিন্নাহ কংগ্রেস শাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত হন এবং সমগ্র ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর 'মুক্তি দিবস' (Day of deliverance) পালন করেন ।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মহম্মদ আলি জিন্নাহ খোলাখুলি বলে দিলেন হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক জাতি । দ্বিজাতি তত্ত্বকে প্রচার করে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে মহম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁর ভাষণে বলেন "ব্রিটিশ সরকারের উচিত এই উপমহাদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধান জাতিগুলিকে স্বতন্ত্র জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ করে দেওয়া । নতুন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকার কথা নয় । কারণ নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কতৃত্ব স্থাপনের আশা দূর হবে । আস্তে আস্তে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হবে । এছাড়া মুসলিম ভারত ও হিন্দু ভারতের মধ্যে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান হবে এবং তাদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষিত হবে ।" লাহোর অধিবেশনের পর মহম্মদ আলি জিন্নাহ পৃথক পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকেন ।
*****
- 879 views