সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি - প্রথম পর্যায় (Background of communal politics) :
ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মোটামুটি মিত্রভাবাপন্ন ছিলেন । ইংরেজ সরকারও ভারতে তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য এই মৈত্রীকে জোরদার করে তুলতে তৎপর ছিল । ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় । ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ নীতি প্রয়োগ করে ইংরেজ সরকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন । ভারতে মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ মুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত । ইংরেজ সরকার কৌশলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে পৃথক করে রেখে ভারতে কংগ্রেসকে দূর্বল করার চেষ্টা করে । মধ্যবিত্তদের উত্থান, বুর্জোয়াদের আবির্ভার, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, আর্থসামাজিক অনগ্রসরতা, আর্যসমাজের উগ্র হিন্দুত্ববাদ, বঙ্গভঙ্গের সময় ব্রিটিশের কুমন্ত্রণা ইত্যাদি ঘটনা ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত তৈরি করেছিল । ধর্মীয় বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক রেষারিষি সৃষ্টি করার জন্য লর্ড ডাফরিন জাতীয় কংগ্রেসকে ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কাউন্সিল আইন দ্বারা পরোক্ষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হয় ।
আগা খান এবং ঢাকার নবাব সালিম উল্লাহ প্রমুখ মুসলিম নেতাগণ সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রচারেও যত্নবান হন । তাঁরা কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়েই প্রাধান্য দিতেন । ইতিমধ্যে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ও আলিগড় আন্দোলনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিভেদপন্থী সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রকাশ করেন । এর ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হয় । আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ থিওডোর বেক -এর প্রভাবে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান জাতীয়তা বিরোধী মতবাদ প্রচার করে মুসলিম সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেন । স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মনে করতেন কংগ্রেস হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হিন্দুদের আন্দোলন । কংগ্রেস নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা দাবি করলে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে— স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি মুসলমানদের প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করে । ব্রিটিশ সরকার এই পরিস্থিতির পূর্ণ সদব্যবহার করেন ।
লর্ড কার্জন ভাইসরয় হয়ে ভারতে আসবার আগেই মুসলমান সমাজের বিশেষ অধিকার সমর্থন করে জাতীয়তাবাদকে দমন করার কথা ঘোষণা করেন । ভারতে এসে তিনি বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন । লর্ড কার্জন যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ান তা পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বমফিল্ড ফুলার আরও বিষিয়ে তোলেন । ব্রিটিশ সরকার নতুন শাসন সংস্কার প্রবর্তন করবেন বলে ঘোষণা করলে আলিগড়ের মুসলিম নেতাগণের এই ধারণা হয় যে নতুন ব্যবস্থায় হিন্দুদের কাছে সব ক্ষমতা চলে যাবে । এজন্য তাঁরা আগা খাঁর নেতৃত্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে তাঁর সিমলার বাসভবনে গিয়ে এক আর্জিতে ভারতীয় মুসলিম সমাজের স্বার্থরক্ষার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থার দাবি জানান । এটি 'সিমলা ডেপুটেশন' নামে পরিচিত । আর্জিতে বলা হয়—
(১) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই সরকারি উচ্চপদে মুসলিমদের নিয়োগ করত হবে ।
(২) মুসলিমদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হবে ।
(৩) প্রশাসনিক পদে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে ।
বড়লাট যথারীতি দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বীজ দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয় । এর ঠিক পরেই মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে রূপ দিতে এবং মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষার নাম করে ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকার নবাব সালিম উল্লাহ 'সারা ভারত মুসলিম লিগ' গঠন করেন । লিগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়—
(ক) ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার সুরক্ষিত করা,
(খ) ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের রক্ষা ও তার প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করা,
(গ) মুসলিম ও অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় করা,
(ঘ) জাতীয় ঐক্য ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সুষ্ঠভাবে গঠন করে স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি ।
এরপর লিগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব মুসলমানদের মধ্যে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগ একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আইন সভায় মুসলিম সদস্য পাঠানোর দাবি তোলে । তাই ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি 'মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন' -এ মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় । এই নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে ইংরেজ সরকার ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছিল । মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি জাতীয় আন্দোলনের গতিকে ব্যাহত করেছিল । মুসলিম সম্প্রদায় ক্রমে জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র অধিকারের কথা চিন্তা করতে থাকেন ।
*****
- 4274 views