দূষণ, বায়ুদূষণ, অ্যাসিড বৃষ্টি :
দূষণ (Pollution) :- গোল্ডস্মিথের (স্বর্ণকার) কর্মযজ্ঞ থেকে উৎপন্ন গ্যাসের দ্বারা বায়ু এবং জলের দূষণ :-
গোল্ডস্মিথ নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করে সোনার মধ্যে মিশে থাকা ক্ষারকীয় ধাতুগুলিকে দ্রবীভূত করে সোনার পরিশোধন করে । ধাতুর সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড । এই নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, জল কিংবা বায়ুর প্রধান দূষক । যদি নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড গ্যাসটিকে বায়ুতে নির্গত করা হয় তাহলে পারিপার্শ্বিক অঞ্চল দূষিত হবে । আবার ওই গ্যাসটিকে যদি জলে প্রবাহিত করা হয় তাহলে গ্যাসটি জলে দ্রবীভূত হয়ে নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরি করবে যা খুবই ক্ষতিকারক । সুতরাং গোল্ডস্মিথ কর্মযজ্ঞকে এমন ভাবে সাজাতে হবে যেন কোনো ভাবে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড বায়ুতে (পরিবেশে) সরাসরি না মেশে । উৎপন্ন নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডকে সংগৃহীত করে জলে প্রবাহিত করলে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করবে যা এই প্রক্রিয়ায় একটি উপজাত । কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা গ্যাস মুখোশ পরবে । এইভাবে দূষণ রোধ করা যাবে ।
বায়ুদূষণ (Pollution of air by SO2) :- বায়ু দূষণের প্রধান সালফার গঠিত যৌগ যাকে বলে সালফার ডাইঅক্সাইড । এই সালফার ডাইঅক্সাইড সাধারণত সালফার ঘটিত মৌলের দহনের ফলে উৎপন্ন হয় । কিছু ধাতব সালফাইড আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের সময় ধাতব আকরিকের দহনের মাধ্যমে ধাতব অক্সাইডে পরিণত করা হয় তার ফলে সালফার ডাইঅক্সাইড নামক গ্যাস উৎপন্ন হয় । তাছাড়া পেট্রোলিয়াম শোধনাগার থেকে বিপুল পরিমাণের SO2 গ্যাস উৎপন্ন হয় । এইভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন SO2 গ্যাস বায়ু দূষণের কারণ হয় ।
অ্যাসিড বৃষ্টি (Acid rain) :- বৃষ্টির সময় মূলত HNO3 এবং H2SO4 মিশ্রিত জল ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে । এ থেকেই অ্যাসিড বৃষ্টির সৃষ্টি হয় । অ্যাসিড মিশ্রিত বৃষ্টির জলকে অ্যাসিড বৃষ্টি বলে । বৃষ্টির সময় মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ-ক্ষরণের সময় যে স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়, তার ফলে বায়ু মন্ডলের উষ্ণতা প্রায় 3000°C মতো হয় । এই উচ্চ উষ্ণতায় বায়ুর নাইট্রোজেন (N2) এবং অক্সিজেন (O2) যুক্ত হয়ে নাইট্রিক অক্সাইড (NO), নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) উৎপন্ন হয় । উৎপন্ন NO2 বৃষ্টির জলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO3) উৎপন্ন করে । ফলে বৃষ্টির জল আম্লিক হয় ।
4NO2 + O2 + 2H2O = 4HNO3
আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের ফলে যে SO2 গ্যাস নির্গত হয় তা বৃষ্টির জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে ।
2SO2 + O2 +2H2O = 2H2SO4 জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা, পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস দহনের ফলে সালফার এবং নাইট্রোজেন, অক্সাইডের আকারে বায়ুমন্ডলে যুক্ত হয় । তাছাড়া সালফাইড আকরিক থেকে সালফার নিষ্কাশন; সীসা, দস্তা এবং তামা নিষ্কাশনের চুল্লি; যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ-উৎপাদন প্রভৃতি উৎস থেকেও SO2 এবং NO2 বায়ুমন্ডলে যুক্ত হয় । এইসব গ্যাস বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে বৃষ্টির জলের অম্লতা বহু গুণ বৃদ্ধি করে । অদূষিত বৃষ্টির জলে কার্বন ডাইঅক্সাইড দ্রবীভূত হয়ে কার্বনিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে । যার ফলে জল সামান্য আম্লিক হয় ।
H2O + CO2 = H2CO3
অ্যাসিড বৃষ্টিজনিত ক্ষয়-ক্ষতি :-
[i] ধাতু এবং ক্ষারকে অ্যাসিড বৃষ্টি তীব্র ভাবে আক্রমণ করে ।
[ii] অ্যাসিড বৃষ্টিতে নদী, হ্রদ ও পুকুরের জল বিশেষ ভাবে দূষিত হয়— জলজ উদ্ভিদ ও মাছের পক্ষে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর ।
[iii] অরণ্যের সংকোচনের প্রধান কারণ অ্যাসিড বৃষ্টি ।
[iv] অ্যাসিড বৃষ্টির দরুন মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় ও কৃষিকার্য দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
ঐতিহাসিক স্থাপত্যসমূহের ক্ষয় :- পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থাপত্য অ্যাসিড বৃষ্টির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । রোমের কেলোসিয়াম, লিঙ্কন মেমোরিয়াল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, ভারতের তাজমহলের পাথরের ক্ষয়ের কারণ হল অ্যাসিড বৃষ্টি । তাছাড়া তাজমহলের কিছু দূরে মথুরা এবং ভারতপুর তেল শোধনাগার থেকে উদ্ভুত আম্লিক গ্যাস (NO2, SO2, CO2 ইত্যাদি) বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে যে অ্যাসিড বৃষ্টির সৃষ্টি হয়, তাজমহলের মার্বেল পাথরের সঙ্গে সেই অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় পাথরের ক্ষয় হচ্ছে ।
CaCO3 + H2SO4 = CaSO4 + CO2 + H2O ; CaCO3 + 2HNO3 = Ca (NO3)2 + CO2 + H2O ।
CaSO4, Ca (NO3)2 -এর উপস্থিতিতে তাজমহলের পাথরের (CaCO3) ঔজ্জ্বল্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে— একটি অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ তার সৌন্দর্য হারিয়ে একটি অনুজ্জ্বল ধূসর বর্ণের সাধারণ প্রস্তর স্তুপে পরিণত হতে চলেছে । অ্যাসিড বৃষ্টির দ্বারা পাথরের এই ক্ষয়কে পাথরের ক্ষয় (stone cancer) বলে ।
প্রতিকারের উপায় :- নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে জলাশয়ে চুন প্রয়োগ করে অ্যাসিডকে প্রশমিত করা যায় । SO2 এবং NO2 উৎপাদন এবং নিক্ষেপ নিয়ন্ত্রিত করতে হবে । খনিজ জ্বালানির বিকল্প লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (LNG) ব্যবহার করতে হবে ।
*****
- 1691 views