উনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলায় ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই সময় বাংলার সমাজজীবনে চরম দুর্দিন চলছিল । হিন্দুসমাজে তখন ব্রাহ্মণদের প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল এবং তারাই সমাজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন । হিন্দুসমাজে প্রকট জাতিভেদ প্রথা চালু ছিল । হিন্দুসমাজ ছিল ভীষণ গোঁড়া ও রক্ষণশীল । ব্রাহ্মণরা সমাজের মধ্যমনি হয়ে থাকলেও তাদের মধ্যে সমাজের কুসংস্কার ও কুপ্রথার প্রচলন সবচেয়ে বেশি ছিল । সে সময়কার সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ নানাভাবে সামাজিক বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হত, কিন্তু সমাজের কুসংস্কার ও কুপ্রথা বা নানাবিধ সামাজিক বিধিনিষেধ তাদেরকে তেমন গভীরভাবে স্পর্শ করেনি । ব্রিটিশ শাসক হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলি নিয়ে প্রথমদিকে তেমনভাবে মাথা ঘামায় নি বা তারা হিন্দুদের সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি । কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল এতে হস্তক্ষেপ করলে স্থানীয় মানুষ অসন্তুষ্ট হতে পারে ।
উনিশ শতকের বাংলায় সামাজিক আন্দোলনের তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায় । প্রথম ধারার বৈশিষ্ট্য হল প্রাচীন সনাতন হিন্দু সমাজ-ব্যবস্থাকে ধরে রাখার জন্য হিন্দুসমাজে একদল গোঁড়া ও রক্ষণশীল মানুষ উঠে পড়ে লেগেছিল । পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে যাতে হিন্দুদের সাবেকি সমাজব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে এবং হিন্দুসমাজের বিভিন্ন রক্ষণশীল কুপ্রথা ও নিষ্ঠুর ব্যবস্থাগুলিকে রক্ষা করতে তারা সর্বদা সচেষ্ট ছিল । তারা সর্বপ্রকার সংস্কারের বিরোধী ছিলেন । আর একটি গোষ্ঠী ছিল উচ্চশিক্ষিত ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণকারী । সমাজের প্রগতিশীল এই সমস্ত ছাত্ররা হিন্দুসমাজের কুপ্রথা বা অত্যাচারের কঠোর সমালোচক ছিলেন । কিন্তু সংস্কার আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক । আর তৃতীয়টি হল এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যবর্তী কিছু স্বচ্ছ দৃষ্টি সম্পন্ন, যুক্তিবাদী, উদার ও সংস্কারপন্থী মানুষ ছিলেন । তাঁদের চিন্তাধারা ছিল বাস্তবসম্মত ও প্রগতিশীল । পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন । দেশীয় সমাজ ও সভ্যতাকে তাঁরা ঘৃণার চোখে দেখতেন না । তাঁরা হিন্দুসমাজকে না ভেঙে শুধুমাত্র সমাজের দোষ-ত্রুটি ও কুপ্রথাগুলির অবসান ঘটিয়ে সমাজের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন । এঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রগণ্য । পরে ব্রাহ্মসমাজ এই কাজে কিছুটা সচেষ্ট হয়েছিল ।
******
- 21110 views