নাইট্রিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড প্রস্তুতি

Submitted by arpita pramanik on Mon, 03/04/2013 - 19:48

নাইট্রিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড প্রস্তুতি :

নাইট্রিক অ্যাসিড (Nitric Acid)

মধ্য যুগের অ্যালকেমিস্টরা সোরা, হিরকস, এবং ফটকিরিকে মিশিয়ে সেই মিশ্রণকে পাতিত করে নাইট্রিক অ্যাসিড প্রস্তুত করেন । সোনা ও প্লাটিনামের মতো কয়েকটি ধাতু ছাড়া বেশির ভাগ ধাতু এবং অধাতু এই অ্যাসিডে দ্রবীভূত হয় বলে তাঁরা এই অ্যাসিডকে অ্যাকোয়া ফর্টিস (Aqua fortis) বা শক্তিশালী জল রূপে (Strong Water) অভিহিত করেন । অষ্টম শতাব্দিতে আরবীয়র রসায়নবিদ জবির ইবন সোরা, হিরকস (FeSO4) এবং ফটকিরিকে মিশিয়ে এবং সেই মিশ্রণকে পাতিত করে অ্যাকোয়া ফর্টিস তৈরি করেন । 1858 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী গ্লবার নাইটার (KNO3) এবং গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের (H2SO4) মিশ্রণ পাতিত করে নাইট্রিক অ্যাসিড (Nitric Acid) প্রস্তুত করেন । নাইট্রিক অ্যাসিডের আণবিক সংকেত (Molecular formula) হল HNO3 এবং আণবিক ভর (Molar mass) হল 63 ।

নাইট্রিক অ্যাসিডের পরীক্ষাগার প্রস্তুতি (Laboratory method of preparation) :

[১] রাসায়নিক উপাদান:- পরীক্ষাগারে নাইট্রিক অ্যাসিড প্রস্তুত করার জন্য  [i] সোডিয়াম নাইট্রেট (NaNO3 -চিলি সল্ট পিটার ) বা পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3 - সোরা) এবং [ii] গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের (H2SO4) প্রয়োজন ।

[২] নীতি (Principle) :- যেহেতু নাইট্রিক অ্যাসিড সালফিউরিক অ্যাসিডের চেয়ে বেশি উদ্বায়ী, সেইজন্য নাইট্রেট লবণের সঙ্গে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিড মিশিয়ে উত্তপ্ত করলে নাইট্রিক অ্যাসিড পাতিত হয়ে আসে । পরীক্ষাগারে সোডিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করা হয় । বিক্রিয়াটি দুটি পর্যায়ে ঘটে । 

প্রথম পর্যায় :- 200°C — 300°C উষ্ণতায় সোডিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে সালফিউরিক অ্যাসিড বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফেট এবং নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে । NaNO3 + H2SO4 = NaHSO4 + HNO3

দ্বিতীয় পর্যায় :- 800°C উষ্ণতায় উৎপন্ন সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফেট, অবশিষ্ট সোডিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম সালফেট এবং নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে । NaNO3 + NaHSO4 = Na2SO4 + HNO3

[৩] পদ্ধতি :-

[i] একটি বক যন্ত্রের মধ্যে সমপরিমাণ সোডিয়াম নাইট্রেট এবং গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিড নিয়ে বক যন্ত্রের ছিপিটি বন্ধ করে একটি ধারকের সাহায্যে দন্ডের সঙ্গে আটকে ত্রিপদ স্ট্যান্ডে রাখা তার জালির ওপর বসানো হল এবং বক যন্ত্রের মুখটি একটি গ্রাহক-ফ্লাস্কের মধ্যে প্রবেশ করানো হল ।

[ii] এই গ্রাহক ফ্লাস্কটিকে জল ভরা পাত্রের মধ্যে রেখে ওপর থেকে ঠান্ডা জলের ধারা এর উপর ফেলে ঠান্ডা রাখা হয় ।

[iii] এইবার বার্নার দিয়ে বক যন্ত্রটিকে 200°C থেকে 300°C উষ্ণতায় উত্তপ্ত করা হল । ফলে বক যন্ত্রের মধ্যে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়ে গ্যাসরূপে গ্রাহক-ফ্লাস্কে যায় এবং সেখানে শীতল ও ঘনীভূত হয়ে তরলরূপে জমা হয় ।

[৪] বিশুদ্ধিকরণ :- এইভাবে উৎপন্ন নাইট্রিক অ্যাসিডের মধ্যে জল ও নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড অশুদ্ধিরূপে বর্তমান থাকে, তাই এর বর্ণ কিছুটা হলুদ হয় । এই অ্যাসিডকে 60°C থেকে 80°C পর্যন্ত উত্তপ্ত করে ওর মধ্য দিয়ে বায়ুর বুদবুদ চালনা করলে NO2 গ্যাস বেরিয়ে যায় । পরে ওর সঙ্গে গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিড (H2SO4) মিশিয়ে কম চাপে পাতন করলে 98% নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO3) পাওয়া যায় ।

নাইট্রিক অ্যাসিড (HNO3) -প্রস্তুতিতে গাঢ় HCl ব্যবহার করা হয় না । কারণ—  HCl খুব উদ্বায়ী । সাধারণ উষ্ণতাতেই বাস্পীভূত হয় । HNO3 -এর চেয়ে HCl অনেক বেশি উদ্বায়ী । তাই নাইট্রেট লবণের সঙ্গে গাঢ় HCl মিশিয় উত্তপ্ত করলে বেশি উদ্বায়ী HCl পাতিত হয়ে গ্রাহক পাত্রে জমা হয় । HNO3 প্রস্তুতিতে গাঢ় HCl ব্যবহার না করে অনুদ্বায়ী H2SO4 ব্যবহার করা হয় ।

ধূমায়মান নাইট্রিক অ্যাসিড :- গাঢ় নাইট্রিক অ্যাসিডের সঙ্গে স্টার্চ মিশিয়ে পাতন করলে পাতিত দ্রব্যরূপে যে নাইট্রিক অ্যাসিড পাওয়া যায়, তাকে ধূমায়মান নাইট্রিক অ্যাসিড বলে । এর মধ্যে NO2 দ্রবীভূত থাকে বলে এর বর্ণ বাদামী হয় । এটি একটি তীব্র জারক পদার্থ ।

[খ] অস্টওয়াল্ড পদ্ধতি (Ostwald's method) :- অ্যামোনিয়া গ্যাস থেকে নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন :

[i] অ্যামোনিয়া গ্যাসকে বায়ুর সঙ্গে মিশিয়ে মিশ্রণটিকে 700°C উষ্ণতায় উত্তপ্ত প্লাটিনাম তারজালির ওপর দ্রুত চালনা করা হয়, ফলে অ্যামোনিয়া গ্যাস বায়ুর অক্সিজেন (O2) দ্বারা জারিত হয়ে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপন্ন করে । এখানে প্লাটিনাম তারজালি অনুঘটকের কাজ করে ।

    4NH3 + 5O2 = 4NO + 6H2O

[ii] উৎপন্ন নাইট্রিক অক্সাইডের সঙ্গে বায়ু মেশালে নাইট্রিক অক্সাইড বায়ুর অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডে পরিণত হয় ।

   2NO + O2 = 2NO2

[iii] এইভাবে উৎপন্ন নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) -এর সঙ্গে গরম জলের বিক্রিয়ায় নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয় ।

   3NO2 + H2O = 2HNO3 + NO ↑

বৃষ্টির জল আম্লিক হয় : কারণ— বৃষ্টির সময় মেঘে-মেঘে বিদ্যুৎক্ষরণে উৎপন্ন স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে 3000°C উষ্ণতায় বায়ুর N2 এবং O2 পরস্পর যুক্ত হয়ে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপন্ন হয় । N2 + O2 = 2NO । এই উৎপন্ন NO, বায়ুর O2 -এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাদামী বর্ণের নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন করে । 2NO + O2 = 2NO2 । এইভাবে উৎপন্ন NO2 বৃষ্টির জলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে HNO2 এবং HNO3 উৎপন্ন করে ।  2NO2 + H2O = HNO2 + HNO3 । এই কারণে বৃষ্টির জল আম্লিক হয় এবং অ্যাসিড বৃষ্টির অন্যতম কারণ হয় ।

*****

Related Items

কৃত্রিম পলিমার ব্যবহারের সমস্যা ও নিয়ন্ত্রণ

কৃত্রিম পলিমার থেকে প্রস্তুত বস্তুসামগ্রীর ব্যবহার যথেচ্ছভাবে দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে । পলিথিন ও টেফলন থেকে তৈরি ব্যাগ ও প্লাস্টিকের থলি এবং অন্যান্য সামগ্রী আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে উঠেছে । প্লাস্টিক এমন একটি দূষক যা প্রকৃতিতে দীর্ঘদিন অবিকৃত থাকে ...

পলিমেরাইজেশন ও কয়েকটি সাধারণ পলিমার

যে বিক্রিয়ায় বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ও সরল অণুর পারস্পরিক সংযোগের ফলে ভিন্ন ধর্ম ও উচ্চ আণবিক ভরবিশিষ্ট (20000 - 250000) অতিবৃহৎ-অণু গঠিত হয় সেই বিক্রিয়াকে বহুলীভবন বা পলিমেরাইজেশন বিক্রিয়া বলে । ওই বিক্রিয়ায় উত্পন্ন বৃহৎ-অণুকে পলিমার বলে । আবার যে সরল...

অ্যালকাইন (Alkyne)

যে হাইড্রোকার্বনে এক বা একাধিক কার্বন-কার্বন ত্রি-বন্ধন থাকে, তাদের অ্যালকাইন বলে। এরা অসম্পৃক্ত জৈব যৌগ । এরা এক অণু হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথমে অ্যালকিন এবং পরে আরও এক অণু হাইড্রোজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অ্যালকেন অণু গঠন করে । এই শ্রেণির যৌগগুলির ...

অ্যালকিন (Alkene)

যে সব হাইড্রোকার্বনে কম পক্ষে একটি কার্বন-কার্বন দ্বি-বন্ধন থাকে, তাদের অ্যালকিন বলে । এই যৌগগুলি হাইড্রোজেনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অ্যালকেন উত্পন্ন করে । কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগে সর্বোচ্চ যতগুলি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকতে পারে তার থেকে ...

অ্যালকেন (Alkane)

যে সব হাইড্রোকার্বনে কার্বন পরমাণুগুলি পরস্পর কেবলমাত্র সমযোজী এক বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে, তাদের অ্যালকেন বলে । এদের গঠনে শুধু কার্বন-কার্বন একবন্ধন এবং কার্বন-হাইড্রোজেন একবন্ধন থাকে । অ্যালকেনগুলি কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত মুক্ত শৃঙ্খল যৌগ ও এর অ্যালকেন ...