১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন (Quit India Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/24/2012 - 09:07

১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন (ভারত ছাড়ো) : [Quit India Movement]

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভারতের বোঝাপড়া শেষ করে দিয়ে গান্ধিজি তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে শুরু করেন । ভারতে ব্রিটিশের উপস্থিতি জাপানকে ভারত আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবে । এই পরিস্থিতিতে গান্ধিজি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল 'হরিজন' পত্রিকাতে 'ভারত ছাড়ো' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন । এই প্রবন্ধে তিনি বলেন "ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে অবসান চাই । ভারতের স্বাধীনতা চাই কেবল ভারতের স্বার্থে নয়— চাই বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং একজাতির ওপর অন্যজাতির আক্রমণের অবসানের জন্য ।" এরপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অধিবেশনে 'কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি' গান্ধিজির 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের প্রস্তাব অনুমোদন করে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই আগস্ট কংগ্রেসের কার্য-নির্বাহক সমিতি গান্ধিজির ঐতিহাসিক 'ভারত ছাড়ো' প্রস্তাবের আইনগত স্বীকৃতি জানায় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট অতি প্রত্যুষে আন্দোলন শুরু হবে । এই প্রস্তাবে বলা হয় ভারতের মঙ্গলের জন্য, বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য, নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান অপরিহার্য । প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিরা একটি সামরিক সরকার গঠন করবেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করবেন । প্রস্তাব অনুমোদনের পর গান্ধিজি দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন, 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' । অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করব, না হয় মৃত্যুবরণ করব । গান্ধিজির এই উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হয় । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল 'করেঙ্গা ইয়ে মরেঙ্গে'

যথারীতি ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট ভোরে গান্ধিজিকে গ্রেফতার করে পুণায় আটক করে রাখে । এরপর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, জে. বি. কৃপালনী সমেত বহু প্রথম সারির নেতা কারারুদ্ধ হন । ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে ঘোষণা করে । সর্বত্র কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয় । প্রথম প্রথম এই আন্দোলন ছাত্র-শিক্ষক, যুবসম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । ক্রমে তা দেশের শ্রমিক, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলনের রূপ নেয় । সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন । দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয় । এ সবের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ নেয় । রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালতে অগ্নি-সংযোগ, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ, থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় ।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি । বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পান্ডে, সরযূ পান্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া অন্যতম । এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য । 

বাংলার মেদিনীপুর জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন এক গণবিদ্রোহের রূপ নেয় । তমলুক ও কাঁথি মহকুমায় এর গভীরতা ও ব্যাপকতা ছিল বেশি । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান বিশেষ ভাবে স্মরণীয় । মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন গান্ধিজির অনুরাগী একজন গ্রাম্য বিধবা মহিলা । মহাত্মা গান্ধি ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে মাতঙ্গিনী হাজরা এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন । মেদিনীপুরে মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে সেপ্টেম্বর নানাদিক থেকে এসে তমলুক থানা ও আদালত অবরোধ করেন । ৭৩ বছর বয়স্কা কৃষকবধু মাতঙ্গিনী হাজরা তমলুক আদালত শীর্ষে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলতে গিয়ে ব্রিটিশের গুলিতে প্রাণ হারান । মাতঙ্গিনী হাজরার দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শ জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে । অজয় মুখার্জি, সুশীল কুমার ধাড়া ও সতীশচন্দ্র সামন্তের নেতৃত্বে লালবাড়ির দখল নেওয়া হয় ও অজয় মুখার্জির উদ্যোগে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর তমলুক মহকুমায় 'তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার' গঠিত হয় । শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারি দমন নীতির প্রচন্ডতা ও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে ।

*****

Related Items

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ । কী কারণে শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়ে ছিল ?

প্রশ্ন:-  আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ । কী কারণে শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়ে ছিল ?

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান—

’করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে’ -কোন আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল ? এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকরা কীরূপ ভূমিকা নিয়েছিল ?

প্রশ্ন:-  ’করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে’ -কোন আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল ? এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকরা কীরূপ ভূমিকা নিয়েছিল ?

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল 'করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে' ।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসার আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসার আলোচনা কর ।

১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট ‘ভারত-ছাড়ো প্রস্তাব’ গৃহীত হলে পরদিন অর্থাৎ ৯ই আগষ্ট, ১৯৪২ এর ভোর থেকেই আন্দোলন শুরু হয়, যেমন—

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কোন ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে স্যার স্ট্যাস্ট্যাস্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স ভারতে এসেছিলেন ?

প্রশ্ন:-  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কোন ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স ভারতে এসেছিলেন ?

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান আলোচনা কর ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান বিশেষভাবে স্মরনীয় ।