স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের অভিমুখ : নব্য বেদান্ত — বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

Submitted by avimanyu pramanik on Thu, 12/10/2020 - 11:57

ভারতের প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যাকর্তা ছিলেন আদি জগৎগুরু 'শঙ্করাচার্য' । 'বেদান্ত' শব্দের অর্থ হল বেদের অন্ত বা শেষ, আর বেদের অন্ত হল উপনিষদসমূহ । ব্রহ্ম হল বেদান্ত দর্শনের মূল আলোচ্য বিষয় । উপনিষদ, ভগবতগীতা এবং ব্রহ্ম সূত্র ও তার ভাষ্য বিবৃতি হল বেদান্ত দর্শনের মূলভিত্তি । ব্রহ্মের স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের ইচ্ছা থেকেই বেদান্ত দর্শনের উদ্ভব শুরু হয় । উপনিষদে ব্রহ্মকে আত্মারূপে অভিহিত করা হয়েছে । শঙ্করাচার্যের দর্শনে ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা । জীব হল ব্রহ্মস্বরূপ অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন—'জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপবঃ' । স্বামী বিবেকানন্দ প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন, যা 'নব্য বেদান্তবাদ' নামে পরিচিত । স্বামীজী বেদান্ত তত্ত্বের প্রচার আর তার সহায়ক উপাদানরূপে কর্মযোগের প্রচার করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন । কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ, ধনী-দরিদ্র্যের বিভেদ দূর করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও কর্মশক্তিতে উদ্দীপ্ত হতে এবং দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সকলকেই শামিল হওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন । বিবেকানন্দের নব্য বেদান্তের অভিমুখ ছিল একটাই— জগতের কল্যাণেই নিজের মোক্ষলাভ । তাঁর ধর্মদর্শন হল মানুষের সেবা করা মানে ঈশ্বরের সেবা । কারণ নরের মধ্যেই নারায়ণের অধিষ্ঠান । বেদান্ত দর্শনকে অত্যন্ত সহজ ও সরলভাবে তিনি প্রচার করেন । স্বামী বিবেকানন্দ ঘোষণা করেন—"জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ।"

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নব্য বেদান্তবাদের আলোকে বলেন খালি পেটে ধর্ম হয় না । দরিদ্রের সেবা করাকেই তিনি পরম ধর্ম বলে উল্লেখ করেন । ভারতের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভ্রমণ করে তিনি দরিদ্র ভারতবাসীর মধ্যে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করেন । গ্রামের কুটিরে, গায়ে ধুলো মাখা ক্ষুধার্ত দেশবাসীই ছিল তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ ভগবান । দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন—'সদর্পে বলো আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, বলো মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই ।'

বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের সারসত্য ব্যাখ্যা করে বলেন, বেদই হিন্দুধর্মের সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ । বেদান্তের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সর্বজনীন ধর্মের ভিত্তিভূমি । তাঁর ধর্মদর্শনের মূল ভিত্তি ছিল পরধর্ম সহিষ্ণুতা । বেদান্তের বাণী হল বৈচিত্রের মধ্যে সমন্বয় । বেদের মধ্যেই রয়েছে ভারতের শাশ্বত আধ্যাত্বিক চিন্তা ও সত্য । বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে । ঈশ্বরকে আরাধনা করতে হলে, তা সাকার না নিরাকার, কোন পথে করতে হবে, তা নির্ভর করে ভক্তের মানসিকতার ওপর । বিভিন্ন ভাষা যেমন ভাবপ্রকাশের মাধ্যম তেমনি বিভিন্ন ধর্ম হল ঈশ্বরপ্রাপ্তির বিভিন্ন পথ । তাই ধর্মে ধর্মে বিরোধের কোনো অর্থ হয় না । আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ যোগদান করে তিনি হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য তুলে ধরেন । তিনি সবাইকে সাবধান করে বলেছিলেন—"যদি কেহ স্বপ্ন দেখেন যে, অন্যান্য ধর্ম লোপ পাবে এবং তার ধর্মই টিকে থাকবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র ।"

স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়কে এক উদার ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন । বৈদান্তিক হৃদয়ের সঙ্গে তিনি ইসলামের দেহের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন । তাঁর ভাষায় "আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামি দেহ —একমাত্র আশা ।" তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, শূদ্ররা যদি চিরদিন এইভাবে অবহেলিত ও শোষিত হতে থাকে, তাহলে তারা একদিন না একদিন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেই এবং গোটা দেশ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে । জাতিভেদের কৃত্রিম বন্ধন ছিন্ন করে সমস্ত হিন্দু একসূত্রে আবদ্ধ হোক—এই ছিল তাঁর স্বপ্ন ।

স্বামী বিবেকানন্দের 'নব্য বেদান্ত' ছিল সমকালীন সময়ের একটি প্রয়োজনীয় ধর্মাদর্শ । কুসংস্কার আর নানান বিধিনিষেধের বেড়াজালে যখন হিন্দু ধর্মের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, তখন মানবপ্রেমের সনাতনী আদর্শের সমন্বয়ে গড়ে তোলা স্বামী বিবেকানন্দের 'নব্য বেদান্তবাদ' মুক্তির পথ দেখায় । 

****

Comments

Related Items

সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন : নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কাজ :

বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

প্রশ্ন : বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?

প্রশ্ন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?