সাঁওতাল হুল (১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 12/28/2020 - 17:45

সাঁওতাল বিদ্রোহ (Santhal rebellion) : ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে যে সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহগুলি ঘটেছিল সেগুলির মধ্যে 'সাঁওতাল বিদ্রোহ' বা 'সাঁওতাল হুল' সবথেকে ভয়াবহ ও জঙ্গি ছিল । সাঁওতালি ভাষায় বিদ্রোহকে হুল বলা হয় । সাঁওতালগণ ছিলেন বাংলা, বিহার ও ওড়িশার একটি বড়ো উপজাতি বা খন্ডজাতি । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে সাঁওতালদের ব্যবহৃত জোতজমি জমিদারদের হাতে চলে যায় । নতুন ব্যবস্থায় তাঁরা জমিচ্যুত ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার সম্মুখীন হন । এই নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে এবং জমিদার ও কোম্পানির কর্মচারীদের অত্যাচারে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালগণ আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বিহারের হাজারিবাগ, ধলভূম, মানভূম, ছোটোনাগপুর, পালামৌ, ওড়িশার কটক, বরাভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম ইত্যাদি অঞ্চল ছেড়ে যেতে শুরু করে । সাঁওতালরা রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে ভাগলপুর ও বীরভূম এলাকায় কঠোর পরিশ্রমে জঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে তোলে এবং পতিত জমি চাষ-আবাদ করে নতুন জীবন শুরু করে । তারা এই নতুন এলাকার নাম দেয় 'দামিন-ই-কোহ', যার অর্থ হল পাহাড়ের পাদদেশ ।

সুদখোর মহাজন শ্রেণি ও ব্যবসায়ীগণ সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করে । অভাবের তাড়নায় এই সব মহাজনদের কাছ থেকে ধারে খাদ্যশস্য বা অর্থ নিলে সাঁওতালদের 'কামিয়াতি' ও 'হারওয়াহি নামে দু-ধরনের বন্ডে সই করতে হত । কামিয়াতি ব্যবস্থায় যতদিন না ঋণ শোধ দিতে পারত ততদিন সাঁওতালদেরকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হত । হারওয়াহি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে বেগার শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্মও করতে হত । সাঁওতাল পরগনাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরলতা ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে সাঁওতালদের বিভিন্নভাবে ঠকাত । তারা বেচারাম বা ছোটো বাউ নামে বাটখারার দ্বারা হিসাবের থেকে কম ওজনের দ্রব্য বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত । আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনো শস্য কেনার সময় হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের কেনারাম বা বরা বাউ বাটখারা ব্যবহার করে বেশি পরিমাণ দ্রব্য ক্রয় করত । লর্ড ডালহৌসির আমলে রেলকর্মচারী ও ঠিকাদারেরা সাঁওতালদের প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে তাদেরকে বঞ্চিত করত । সাঁওতালদের থেকে তারা জোর করে হাঁস, মুরগি, পাঁঠা কেড়ে নিত । ইংরেজ সেনা অনেক ক্ষেত্রে সাঁওতাল রমণীদের সম্মান হানি করায় সাঁওতালগণ নিজেদের অপমানিত বোধ করেন । সরকারি তরফে দিনের পর দিন অধিক হারে রাজস্ব আদায় করা শুরু হলে তারা বিদ্রোহের পথে যায় । ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন গোক্কো ও বীরসিং নামক গোষ্ঠীপতিদের ওপর ইংরেজ সরকারের উৎপীড়নের প্রতিবাদে হাজার হাজার সাঁওতাল লাঠি, বল্লম, তির, ধনুক নিয়ে দামিন অঞ্চলে সমবেত হন এবং বেপরোয়া লুঠতরাজ এবং দারোগা ও মহাজনদের হত্যার নেশায় মেতে ওঠেন ।

এইসব অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে সাঁওতালরা সিধু ও কানহু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন ভাগনাডিহির মাঠে সমবেত হয় ও স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে । সাঁওতালদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সিধু ও কানহু ছাড়াও চাঁদ ও ভৈরব নামে দুই ভাই, বীর সিং, কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমূখরা এগিয়ে আসে । ভাগলপুর, সিংভূম, মুঙ্গের, হাজারিবাগ, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের একাংশ বিদ্রোহের কেন্দ্রে পরিণত হয় । পাকুরের রাজবাড়ি এবং অম্বর পরগনার জমিদারের কাছারি বাড়িতে আক্রমণ চালানো হয় । কুখ্যাত মহাজন কেনারাম ভগৎ এবং দীঘী থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয় । রেলস্টেশন, ডাকঘর, থানা, ব্রিটিশদের বাংলো এবং দেশীয় জমিদারদের ঘরবাড়ি সাঁওতালদের আক্রমণের নিশানা হয় । তাঁরা ভাগলপুর ও রাজমহলের মধ্যে ডাক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় । সমগ্র অঞ্চল বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় । বহু সহস্র ইংরেজ কর্মচারি, জমিদার, মহাজন, বিদ্রোহী সাঁওতালদের হাতে প্রাণ হারান । ক্রমান্বয়ে সাধারণ মানুষও এই সাঁওতাল বিদ্রোহে যোগদান করে । কামার, কুমোর, গোয়ালা, তেলি, চামার, বাগদি, হাড়ি, ডোম প্রভৃতি নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের মোমিনগণ এই বিদ্রোহে যোগ দিলে সাঁওতাল বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের চেহারা নেয় । ব্রিটিশ শাসক প্রথম দিকটায় এই বিদ্রোহকে গুরুত্ব দেয় নি । মেজর বুরাফ নামক এক ইংরেজ সেনাপতি সাঁওতালদের হাতে পরাজিত হলে এই বিদ্রোহের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ।

শেষ পর্যন্ত সুবিশাল সেনাবাহিনী সাহায্যে ব্রিটিশ সরকার কঠোরভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন করে । এতে চাঁদ ও ভৈরব নিহত হন এবং সিধু, কানহু-সহ অন্যান্য নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয় । ইংরেজ গোলান্দাজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীরধনুকের লড়াই ভারতের ইতিহাসে গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছে ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ উত্তরে গঙ্গার কাছাকাছি তেলিয়া গড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুর থেকে ৯,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেয় । এই এলাকা একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে এনে 'সাঁওতাল পরগনা' নামে সাঁওতালদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা গঠন করা হয় । বলা হয় সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোনো আইনবিধি কার্যকর করা হবে না । সমগ্র সাঁওতাল পরগনায় পুলিশ বাহিনীর বদলে মাঝি, পরগনাইত প্রভৃতি সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের বিশেষ অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তাদের ওপরই শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় । বাজেয়াপ্ত গবাদিপশু সাঁওতালদের পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় । সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । তিন বছরের জন্য ওই পরগনায় মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় । সেখানে ইউরোপীয় মিশনারিদের প্রবেশাধিকার দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নীতি গৃহীত হয় । সাঁওতালদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয় ।

বৈশিষ্ট্য : সাঁওতাল বিদ্রোহের বেশকিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল—

(১) সাঁওতাল বিদ্রোহ আগাগোড়া ছিল ইংরেজ বিরোধী এক উপজাতি সংগ্রাম ।

(২) এই বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির মিলিত প্রতিবাদ ।

(৩) এই বিদ্রোহ ছিল আক্ষরিক অর্থেই দরিদ্র জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ । কেন না এই বিদ্রোহে শুধুমাত্র সাঁওতালরাই নয়, স্থানীয় কুমোর, তেলি, কর্মকার, গোয়ালা, চামার, ডোম এমনকি মুসলিম তাঁতি প্রভৃতি পেশার মানুষ যোগ দেয় ।

(৪) এই বিদ্রোহে হিন্দুসম্প্রদায়ভুক্ত আধা -আদিবাসী শ্রেণি এবং নিম্নবর্গের গরিব হিন্দুরাও যোগ দিয়েছিল ।

*****

Comments

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা