সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 02/15/2021 - 19:07

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয়তাবাদী জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারার পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সমান্তরালভাবে পরিচালিত হয়েছিল । পরাধীন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনগুলির ওপর দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের অনেকে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের যথার্থ ধারা হিসাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে । মূলত চরমপন্থী মতবাদের উত্থানের মধ্যে দিয়ে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটে । ভারতীয় বিপ্লববাদ প্রথমের দিকে হিন্দুধর্ম ও তার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয় । তাই ইংরেজ ঐতিহাসিক ভ্যালেন্টাইন চিরোল তাঁর 'ইন্ডিয়ান আনরেস্ট' (Indian Unrest) গ্রন্থে ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে 'হিন্দু বিদ্রোহ' বলে উল্লেখ করেছেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়কালে গুপ্তহত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে অচল করে দেওয়া ছিল বিপ্লবীদের লক্ষ্য । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গুপ্ত হত্যার পথ থেকে সরে এসে বিপ্লবীরা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পথ ধরে এগিয়ে চলে ।

ভারতে মহারাষ্ট্রে প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । বরোদা কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন অরবিন্দ ঘোষ ভবানী মন্দিরের অনুকরণে মহারাষ্ট্রে 'ভারতীয় বিদ্যালয়' স্থাপন করেন । বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রদের রণনীতির শিক্ষা দেওয়া হত । পুনার ফার্গুসন কলেজ চত্বরে বিনায়ক দামোদর সাভারকারের আবাসনে বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি তৈরি করে সেখানে ছাত্রদের গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পাঠ দেওয়া হত । দামোদর হরি চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর নামে দুই ভাই হিন্দু ধর্মের অন্তরায় বিনাশী সংঘ নামে এক গুপ্ত সমিতি গঠন করে । বালগঙ্গাধর তিলকের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু ছাত্র 'বালসমাজ' নামে এক বিপ্লবী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রচার করে । ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিনায়ক দামোদর সাভারকর 'মিত্র মেলা' নামে এক সংঘ গড়ে তোলেন । ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এই 'মিত্র মেলা' -র নাম হয় 'অভিনব ভারত' । বোম্বাই ও পুনার প্রতিটি কলেজে 'অভিনব ভারত' -র শাখা গড়ে ওঠে ।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে একাধিক গুপ্তসমিতি গড়ে ওঠে । যেমন— সতীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতি, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত যুগান্তর দল, সরলাদেবীর প্রেরণায় গঠিত বীরাষ্টমী সংস্থা, পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা অনুশীলন সমিতি, ময়মনসিংহের 'সাধনা সমিতি' ও 'সুহৃদ সমিতি' ফরিদপুরের 'ব্রতী সমিতি', ঢাকায় 'মুক্তি সংঘ' প্রভৃতি ।

অত্যাচারী ব্রিটিশ বিচারপতি কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বোমা ছুঁড়ে ভুল করে মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন । এই ঘটনায় প্রফুল্ল চাকি গ্রেপ্তারের আগেই আত্মহত্যা করেন ও ক্ষুদিরাম বসু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে । বিচারে ক্ষুদিরাম বসু ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ই আগস্ট ১৭ বছর বয়সে ফাঁসিতে প্রাণ দেন । বাংলার বহু বিপ্লবীর বিরুদ্ধে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আলিপুর মামলা, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা, হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা প্রভৃতি দায়ের করা হয় । ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী বাঘাযতীন উড়িষ্যার বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে মারা যান । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিনয়-বাদল-দীনেশ কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করেন, যা ইতিহাসে 'অলিন্দ যুদ্ধ' নামে পরিচিত ।

শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন বিশেষ সাফল্য পাচ্ছিল না, তখন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ব্রিটিশ প্রসাশনকে আতঙ্কিত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং ভারত থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করে ।

*****

Comments

Related Items

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

প্রশ্ন : 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন : হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

প্রশ্ন : উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?