মাস্টারদা সূর্যসেন (Surya Sen)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 02/16/2021 - 12:00

মাস্টারদা সূর্যসেন (Surya Sen):-

ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত । তাঁর ডাকনাম ছিল কালু । সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশীবালা সেন ।

সূর্য সেন প্রথমে দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশুনা করেন ও পরে নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন । তারপর তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন । ন্যাশনাল স্কুল থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন । সে সময় আই.এ বা বর্তমানের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল । চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন । তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন । ফলে, তাকে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ পড়তে যেতে হয় । এই কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন ।

বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ পাশ করে চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন । অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত 'উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে' অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন । শিক্ষকতা করার কারণে তিনি 'মাস্টারদা' হিসেবে পরিচিত হন ।

বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স -এর সদস্যদের মধ্যে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল প্রমুখের সাহায্যে মাস্টারদা সূর্যসেন 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি' নামে এক সমরবাহিনী গঠন করেন । 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি' এক ইস্তাহারে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে 'প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা' করে ।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদার নেতৃত্বে গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, উপেন ভট্টাচার্য, নরেশ রায়, ত্রিগুণা সেন প্রমূখ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন । রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, একটি সুইস বন্দুক ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করে বিপ্লবীরা কাছের জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন । খবর পেয়ে ব্রিটিশ পুলিশবাহিনী পাহাড়টিকে ঘিরে ফেলে ও ব্রিটিশ পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়, যা ইতিহাসে 'জালালাবাদের মুক্তি যুদ্ধ' নামে পরিচিত । এই মাতৃমুক্তি যুদ্ধে নরেশ রায়, ত্রিগুণা সেন, পুলিন ঘোষ, জিতেন দাশগুপ্ত, মধু দত্ত, মতি কানুনগো, বিধু ভট্টাচার্য, প্রভাস বল, শশাঙ্ক দত্ত ও ১৩ বছরের কিশোর হরিগোপাল বল (টেগরা) পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন ।

মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । এই আক্রমণের নেতৃত্বভার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর অর্পণ করেন । প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন । প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে শান্তি চক্রবর্তী, কালিকিঙ্কর দে সহ ১৫ জন বিপ্লবী পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব ঘিরে ফেলেন । পুলিশ পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয়পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয় । বিপ্লবীরা বহু ইংরেজকে হতাহত করেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি । বিপ্লবীদের অনেকেই সংঘর্ষস্থল ছেড়ে পালাতে সক্ষম হলেও গুলিতে আহত প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন ।

মাস্টারদা সূর্য সেন পরিকল্পিত চট্টগ্রামের ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্বভার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর ন্যাস্ত করলে কল্পনা দত্ত ঐ দলের সহযোগী হন । ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নির্দিষ্ট দিনের এক সপ্তাহ আগে পুরূষের ছদ্মবেশে একটি সমীক্ষা করতে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও গ্রেফতার হন । জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কল্পনা দত্ত ও তাঁর কয়েকজন সঙ্গী চট্টগ্রামের গৈরালা গ্রামে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় । সংঘর্ষের পর ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাদের গোপন ডেরা ঘিরে ফেললে কল্পনা দত্ত পালাতে সক্ষম হলেও মাস্টারদা সূর্য সেন পুলিশের হাতে বন্দি হন । মামলার বিচারে বিপ্লবী সূর্য সেনের ফাঁসির আদেশ হয় । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি তাঁর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় ও তাঁর মৃতদেহ বহুদূরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় ।

****

Comments

Related Items

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

প্রশ্ন : সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O) প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা কর । জাতিপুঞ্জের প্রধান সংস্থাগুলির নাম কর ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা সংক্ষেপে লেখ ।

প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা

সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর ।

ভারতের বিচারব্যবস্থার শীর্ষে আছে সুপ্রিমকোর্ট । এই সুপ্রিমকোর্ট একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত এবং আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে ।

রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

প্রশ্ন :  রাজ্যপালের ক্ষমতা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা কর ।

(১) রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজ্যপাল । রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতা তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকে ।

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।

প্রশ্ন : ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তাৎপর্য ও জাতীয় কংগ্রেসের সাফল্য সম্পর্কে লেখ ।