ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন (Brahmo Movement)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 22:45

ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন (Brahmo Movement) :

আধুনিক ভারতের রূপকার রাজা রামমোহন রায় উনবিংশ শতাব্দীর ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে বেদান্তের একেশ্বরবাদের ওপর ভিত্তি করে রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেন । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে ‘ব্রাহ্মসভা‘য় পরিণত করেন । ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে এটি আবার ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় । ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক । তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে । ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সমাজ ও ধর্মসংস্কার । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে সেপ্টেম্বর রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ঘনিষ্ট সহযোগী রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ নিষ্ঠা ও আন্তরিক পরিচর্যার দ্বারা ব্রাহ্মসমাজকে রক্ষা করেছিলন । পরবর্তীকালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেন -এর প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ একটি ধর্মীয় সংগঠনে পরিণত হয় । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের ভার গ্রহণ করে একে ব্রাহ্মধর্ম নামে নতুন এক ধর্ম হিসাবে প্রতিপন্ন করেন । রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলেও নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতেন । ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে ডিসেম্বর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কতিপয় বন্ধু ও আত্মীয় পরিজনসহ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । তাঁর উদ্যোগে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী সভা এবং ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয় । এই দুটি প্রতিষ্ঠান উনবিংশ শতাব্দির বাংলার শিক্ষা, সমাজ ও সাংকৃতিক জীবনকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছিল । এই দুটি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসাবে কাজ করত । পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন ।

কেশবচন্দ্র সেনের যোগদানে ব্রাহ্ম আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে । তাঁর প্রচেষ্ঠায় ব্রাহ্ম আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । কেশবচন্দ্র সেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত অনুরাগী ছিলেন । কেশবচন্দ্র সেনের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ব্রহ্মানন্দ উপাধি দান করেছিলেন । কিছুদিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশবচন্দ্র সেনকে ব্রাহ্মসমাজ থেকে অপসারিত করেন । ফলে কেশবচন্দ্র সেন তাঁর তরুণ অনুগামীদের নিয়ে 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ' নামে একটি পৃথক ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন । পুরোনো ব্রাহ্মসমাজ 'আদি ব্রাহ্মসমাজ' নামে পরিচিত হয় । কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে নতুন ব্রাহ্ম সমাজ অচিরেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অসাধরণ জনপ্রিয়তা লাভ করে । তিনি সমাজ সংস্কার ও জনসাধারণের নৈতিক উৎকর্ষ বিধানের জন্য ভারতীয় সংস্কার সভা নামে একটি সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন । এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রধান কর্মসূচিগুলি ছিল শিক্ষাবিস্তার, নারীপ্রগতি, সুলভ সাহিত্য প্রকাশ, সেবাকার্য, মাদক দ্রব্যাদি বর্জন প্রভৃতি ।  খুব শীঘ্রই কেশবচন্দ্র সেনের সংস্কার তাঁর অনুগামীদের কাছে যথেষ্ট প্রগতিশীল এবং গ্রহণযোগ্য বলে মনে না হওয়ায় তাঁদের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের মত বিরোধ দেখা দেয় । ফলে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের অনুগামীরা বাঙালি মনীষী শিবনাথ শাস্ত্রীর দায়িত্বে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নামে পৃথক একটি ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন । কেশবচন্দ্র সেনের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি 'নববিধান' নামে পরিচিত হয় ।

ব্রাহ্মসমাজের সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য :

(১) সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলা ।

(২) পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি সাধন, বিধবা বিবাহের আইনসিদ্ধ করণ, বহুবিবাহ প্রথার নিষিদ্ধ করণ, নারীজাতির মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন প্রভৃতি নারীকল্যাণ মূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থানের সামগ্রিক উন্নতি সাধন ।

(৩) সমাজসেবা ও জনসেবা মূলক কাজের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ।

(৪) উদার নৈতিক ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় সংহতির পথ রচনা ।

ব্রাহ্ম সমাজের দুটি সমাজ সংস্কার বিষয়ক নীতি ছিল

(১) হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথার অবসান ঘটানো । সেই সঙ্গে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন করে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা ।

(২) ব্রাহ্ম সমাজের অপর সমাজ সংস্কার মূলক বিষয় ছিল সমাজসেবা ও জনসেবা মূলক আদর্শের প্রতিষ্ঠা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় মানুষকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা । এক্ষেত্রে ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম নেতা কেশবচন্দ্র সেন একদল তরুণকে নিয়ে ত্রাণ কমিটি গঠন করার যে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, তা পরবর্তীকালে রাককৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান আদর্শ হয়ে ওঠে ।

ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রভাব:- উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে ব্রাহ্মগণ সার্থক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বার্হ্ম সমাজের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় । স্বয়ং রামকৃষ্ণ দেবও এই ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন । স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম জীবনে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি সাধন, বিধবাবিবাহ প্রথার প্রচলন, বহুবিবাহ প্রথার নিষিদ্ধকরণ, নারীজাতির মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন, সতীদাহ নিবারণ প্রভৃতি নারীকল্যাণ মূলক সমাজ সংস্কারের কাজ করে ব্রাহ্মসমাজ সমসাময়িককালের হিন্দু সমাজের বিশেষ করে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থানের সামগ্রিক উন্নতি সাধন করে গেছেন ।

*****

Related Items

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন:-

১. সুই মুন্ডা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন—                [মাধ্যমিক-২০১৭]       

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা

বহু বিকল্পীয় প্রশ্নোত্তর (M.C.Q) - সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা:-

মাধ্যমিকের নমুনা প্রশ্ন :-

১.  'বামাবোধিনী' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন—          [মাধ্যমিক- ২০১৭]

ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ ও বিতর্ক

ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to Linguistic Reorganization of States):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে । স্বাধীনতা লাভের পর ন

আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ

আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথায় দেশভাগ :-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নাম দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় । মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চ

১৯৪৭-পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ ও বিতর্ক

১৯৪৭-পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiative Undertaken and Controversies Related to the Refugee Problem in Post-1947 India) :-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব