বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 02/23/2021 - 22:06

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ(Development of Dalit Politics and Movements in Twentieth Century India):-

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী যে জাতীয় আন্দোলনগুলি সংঘটিত হয় তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, (ii) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, (iii) ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন, (iv) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন । এই সব আন্দোলন চলাকালে নারী, ছাত্র এবং নিম্নবর্গের দলিত শ্রেণির বহু মানুষও এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিতে অংশগ্রহণ করে । এসবের পাশাপাশি ভারতে দলিতশ্রেণি নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে । এই প্রসঙ্গে বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে ।

ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় জুড়ে সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষ উপেক্ষিত । সমাজের তথাকথিত ওপর তলার উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গের শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুর হাল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের করায়ত্ত করে রাখত । নিচু তলার মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে সমাজের ওপর তলার মানুষদের সমীহ করে চলত বা চলতে বাধ্য হত । তারা সমাজের ওপর তলার মানুষদের ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করার সাহস করত না । উচ্চশ্রেণির মানুষরা ছিল নেতা এবং নিম্নশ্রেণির মানুষরা ছিল তাদের অনুগামী । প্রয়োজন ছাড়া এই নেতারা নিম্নশ্রেণির মানুষদের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক রাখত না । নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিজস্ব মতামত সম্বন্ধে উচ্চশ্রেণির মানুষরা বরাবরই উদাসীন ছিল । নিম্নশ্রেণির মানুষদের নিজস্ব আন্দোলন, যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে সমাজের ওপর তলার মানুষের কোনো আগ্রহ ছিল না । তারা এই সব আন্দোলন সমর্থন না করে এর বিরোধিতা করেছেন ।

উনিশ শতকের শেষদিক থেকে অব্রাহ্মণ, নীচু জাতের হিন্দু ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায় তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এইসব নিম্নসম্প্রদায়ের মানুষ দলিত নামে পরিচিত হয় । গান্ধিজি এদের 'হরিজন' বলে অভিহিত করেছেন । এইসব মানুষ হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও এদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না । দারিদ্র্য ছিল এদের নিত্যসঙ্গী মূলত দৈহিক পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করত । লেখাপড়ার সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক ছিল না । ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সমস্যা নিয়েও মাথা ঘামায়নি । তারা হিন্দু ধর্ম ও সমাজব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি । ব্রিটিশ শাসনকালে দলিতদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি, আগের মতোই তারা বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হত । উনিশ শতকে হিন্দু ধর্ম ও সমাজে যে সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তাতেও এইসব মানুষের কথা চিন্তা করা হয়নি ।

পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুপ্রবেশ ও খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপের ফলে দলিতরা তাদের আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে জাতি আন্দোলন সংগঠিত হয় । বাংলায় জাতিগত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নমঃশূদ্রদের মধ্যে এই ধরনের আন্দোলন হয়েছিল । নীচু জাতির গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা উঁচু জাতিতে ওঠার চেষ্টা করেছিল । অনেকেই ব্রাহ্মণদের অনুকরণে পৈতে ধারণ করে । উচ্চবর্ণের পূজায় অংশগ্রহণ, মন্দিরে প্রবেশাধিকার, ঈশ্বর দর্শন ইত্যাদির জন্য এইসব আন্দোলন সংগঠিত হয় । ১৯২৯ সালে বাংলায় মুন্সিগঞ্জ কালিমন্দির সত্যাগ্রহ শুরু হয় । ধর্মীয় অধিকারের পাশাপাশি তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছ থেকে সামাজিক অধিকারও দাবি করে এবং এর জন্য তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও অবতীর্ণ হয় ।

নমঃশূদ্রদের মধ্যে মতুয়া সম্প্রদায় সাদাসিধে ভক্তি ও সামাজিক ঐক্যের কথা তুলে ধরে । কোনো কোনো সম্প্রদায় মনে করত যে তারাই ছিল ভারতের আদি বাসিন্দা এবং বহিরাগত আর্যরা তাদের অবনমিত করে রেখেছে । বাংলায় অস্পৃশ্য হাঁড়িদের মধ্যে বলাহাঁড়ি সম্প্রদায় মনে করে হাঁড়িরাই সমাজের উচ্চতম শিখরে ছিল, আর ব্রাহ্মণদের স্থান ছিল সবার নীচে । এইসব আন্দোলন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী হলেও হিন্দু সমাজে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজের ঐক্য বিপন্ন করেছিল । বিংশ শতাব্দীতে জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা হস্তান্তর করা । তারা দলিতদের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে বা কোনো সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক ছিল না । জাতীয় কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গি দলিতদের হতাশ করেছিল ।

খ্রিস্টীয় তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় সমাজে অস্পৃশ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে । এই সময়ে অস্পৃশ্যরা পঞ্চম জাতি নামে পরিচিত হয় । সমাজের একটি অংশ হলেও সমাজ থেকে পরিত্যক্ত হয়ে অস্পৃশ্যদের বেঁচে থাকতে হত । লোকালয় থেকে পৃথক হয়ে দুরে গিয়ে তারা বসবাস করতে বাধ্য হত । সাধরণের জন্য নির্দিষ্ট কূপ, জলাশয় ব্যবহারের অধিকার, লেখাপড়ার অধিকার, দেবালয়ে প্রবেশের অধিকার প্রভৃতি থেকে এরা বঞ্চিত ছিল । সকল প্রকার নোংরা পরিস্কার, পশুর মৃতদেহ সৎকার, শ্মশানের রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত । সামাজিক পীড়ন ও কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে এই দলিত শ্রেণি অবদমিত ছিল । কেরালার ইঝাভা ও পুলায়া, তামিলনাড়ুর নাদার, মহারাষ্ট্রের মাহার, উত্তরপ্রদেশ ও ছত্রিশগড়ের চামার, বাংলার মতুয়া, সাহেব ধনী, বলাহাঁড়ি প্রভৃতি কয়েকটি দলিত গোষ্ঠী ।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে জন্ম ও মর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন জাতিভুক্ত করে জনগণনার কাজ শুরু করা হয় । ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথমদিকে সামাজিক সমস্যাকে কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি । ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে খেলাল জাতিভুক্ত দলিতরা তামিল ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে জাস্টিস পার্টি গঠন করে । উচ্চবর্ণের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করে জাস্টিস পার্টি ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলমান সম্প্রদায়ের মতো দলিতদের জন্য আসন সংরক্ষণের দাবি পেশ করে । দাবি মেনে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন অনুযায়ী মাদ্রাজ লেডিজ নেটিভ কাউন্সিলে দলিতদের জন্য ২৮টি আসন সংরক্ষিত হয় । পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেস সামাজিক সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় ও সামাজিক অবমাননা থেকে দলিতদের রক্ষার কথা বলে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গাইকোয়াড়ের সভাপতিত্বে বরোদায় দলিত শ্রেণির মানুষদের নিয়ে এক অধিবেশনে বালগঙ্গাধর তিলক বলেন—"ঈশ্বর যদি অস্পৃশ্যতা স্বীকার করে নেন আমি ঈশ্বরকে অস্বীকার করব ।" ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস নেতা ই ভি রামস্বামী নায়কার জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করে দলিতদের নিয়ে ভাইকম মন্দির সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন ও ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেলফ রেসপেক্ট লিগ গঠন করে সমগ্র তামিলনাড়ু জুড়ে দলিত আন্দোলন সংগঠিত করেন ।

বাবাসাহেব আম্বেদকর সর্বপ্রথম দলিতদের নিয়ে প্রকৃত অর্থে আন্দোলন শুরু করেন । অনুন্নতদের মধ্যে শিক্ষা ও আর্থিক উন্নতি ঘটানো  উদ্দেশ্যে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে বোম্বাই শহরে 'বহিস্কৃত হিতকারিণী সভা' গঠিত হয় । এই সভার মুখপত্রের নাম ছিল 'বহিস্কৃত ভারত' । মহারাষ্ট্রের পোলাবা জেলার পানীয় জল ব্যবহারকে কেন্দ্র করে দলিতদের জল পাওয়ার অধিকার আদায়ের উদেশ্যে আম্বেদকরের নেতৃত্বে মাহার সত্যাগ্রহ পরিচালিত হয় । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি প্রকাশ্যে মনুস্মৃতি গ্রন্থটি পুড়িয়ে দিয়ে জাতপাতের বিরোধিতা করেন । প্রাচীন ভারতের এই মনুস্মৃতি গ্রন্থটিতে অস্পৃশ্যতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে । ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে বাবাসাহেব আম্বেদকর কলারাম মন্দির সত্যাগ্রহ পরিচালনা করেন । জাতীয় কংগ্রেস দলিতদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বাবু জগজীবন রামের নেতৃত্বে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে 'অল ইন্ডিয়া ডিপ্রেসড ক্লাসেস লিগ' গঠন করে ।

*****

Comments

Related Items

বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড.মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল ?

'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

প্রশ্ন : 'বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা' -কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?

হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

প্রশ্ন : হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল ?

উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

প্রশ্ন : উনিশ শতকে নারীশিক্ষা বিস্তারে ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ?

'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?

প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটক থেকে উনিশ শতকের বাংলার সমাজের কীরূপ প্রতিফলন পাওয়া যায় ?