বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (Students' Movements in Twentieth Century):-
বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দোলন হল—(i) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন, (ii) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, (iii) ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন, (iv) ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলন । এই চারটি আন্দোলন পর্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও ভারতের ছাত্র সমাজ অসীম সাহসের পরিচয় রাখে । ঊনিশ শতক থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ, ভারতের জাতীয় নবজাগরণ প্রভৃতি ছাত্রদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে থাকে ।
উনিশ শতকের প্রথমদিকে হিন্দুধর্মের পোত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করার উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও -র নেতৃত্বে 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' নামে একটি বিতর্কসভা প্রতিষ্ঠিত হয় । সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর তরফে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে 'পার্থেনন' পত্রিকা প্রকাশিত হয় । এই পার্থেনন পত্রিকা ছাত্রসমাজকে প্রথম সংঘবদ্ধ হতে শেখায় । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু কলেজের (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) কিছু ছাত্র মনুমেন্টের মাথা থেকে ব্রিটিশদের ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর পতাকা ওড়ায় । নব্যবঙ্গীয়দের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ সহ কলকাতার নানা কলেজের ছাত্ররা মিলিত হয়ে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে 'সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা' নামে এক সংগঠন গঠন করে । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে আনন্দমোহন বসু ও তরুণ ব্রাহ্ম ছাত্রদের উদ্যোগে ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ছাত্রসংগঠন 'স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন' গঠিত হয় । এই সমস্ত সংগঠনের নেতৃত্বে ভারত তথা বাংলার ছাত্রসমাজ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে শুরু করে ।
ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল তাদের অনমনীয় মনোভাব এবং প্রবল প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা । তাদের অনমনীয় সংগ্রামী মনোভাবের জন্য তাদের প্রতি আমাদেরকে বিশেষ শ্রদ্ধাশীল করে তোলে । প্রবল ভাবাবেগ ও অতিরিক্ত উৎসাহে ছাত্ররা যেমন আন্দোলনের প্রাণ সঞ্চার করে, তেমনই তাদের বাস্তব বোধের অভাব বিভিন্ন আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকেও উন্মোচিত করে । পরবর্তীকালে ১৯২০ -এর দশকের শেষদিকে এবং ১৯৩০ -এর দশকে ভারতের ছাত্র আন্দোলনে সাম্যবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে । ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের রুশ বিপ্লব ও সাম্যবাদী মতাদর্শ ভারতের ছাত্রসমাজকেও প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল । ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও যুব সংগঠন গড়ে ওঠে এবং ছাত্ররা বিপ্লবী সাম্যবাদে আকৃষ্ট হয় । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রদের নিজস্ব সংগঠন 'নিখিল ভারত ছাত্র সংগঠন' বা 'অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশন' (AISF) গঠিত হয় । সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রসম্প্রদায় ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে তুলনামূলকভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিল ।
*****