বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 12/28/2020 - 18:05

ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement) : ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’ । আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন । ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ । তিনি আরবের ওয়াহাবিদের অনুকরণে ধর্মসংস্কারের কথা প্রচার করতে শুরু করেন । উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা করেন দিল্লীর খ্যাতনামা মুসলিম নেতা সন্ত ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর পুত্র আজিজ । প্রথম দিকে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ । ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণত হয় । সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে । এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা । ওয়াহাবিগণ দ্রুত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য তাঁরা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবিগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার জয় করেন । কিন্তু তাদের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি । ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ প্রাণ হারান এবং ওয়াহাবিরা পরাস্ত হন । পাঞ্জাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার ওয়াহাবিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন । ক্রমশ বাংলা, বিহার, মীরাট ও অন্ধ্রের হায়দরাবাদে ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তারলাভ করে ।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal):- বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমির । তিতুমিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রাম বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয় । তিনি কিছুদিন মুসলিম তীর্থস্থান মক্কায় অবস্থান করেন । সেইখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন । তিতুমির তার অনুগামীদের ওয়াহাবি আদর্শ মেনে বলেন পির-পয়গম্বরকে মানার প্রয়োজন নেই, মন্দির, মসজিদ তৈরির প্রয়োজন নেই, ফয়েতা বা শ্রাদ্ধশান্তি অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই, অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে, সুদে টাকা খাটানো নিষিদ্ধ কাজ । তিতুমির ও তার অনুগামীরা অন্যান্যদের ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত করতে শুরু করেন । কৃষ্ণদেব রায়ের জমিদারি পুঁড়া গ্রামে তিতুমিরের জনপ্রিয়তা সবথেকে বেশি বৃদ্ধি পায় । তিতুমির প্রথমে ওই গ্রামে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় । এতে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবিদের কাছ থেকে বলপূর্বক জরিমানা আদায় করতে শুরু করেন । ওয়াহাবিদের কর্তৃত্ব খর্বের জন্য তিনি ওয়াহাবিদের দাড়ি রাখার ওপর আড়াই টাকার কর ধার্য করেন । তা ছাড়াও কৃষ্ণদেব রায় আদেশ দিয়ে বলেন তাঁর জমিদারি এলাকার মধ্যে ওয়াহাবি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলে পাকা ইটের তৈরি বাড়ির ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা ও কাঁচা মাটির বাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কর আদায় করা হবে । এতে তিতুমির ও তাঁর অনুগামীরা ক্ষিপ্ত হন । কর আদায়কে কেন্দ্র করে তিতুমিরের অনুগামীদের সঙ্গে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের লোকজনদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে । তিতুমির নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে ২৪ পরগনা জেলার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে জনসাধারণের অর্থ সাহায্যে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে নিজের মতো স্থানীয় প্রশাসন চালাতে থাকেন । এই প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মইনুদ্দিন বিশ্বাস, সেনাপতি হন তিতুমিরের ভাগ্নে গোলাম মাসুম এবং মিস্কিন শাহকে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় । তিতুমির এখান থেকে জমিদার, নীলকর এমনকি বারাসাত থেকে বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চলা কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন । তিতুমির সুদখোর মহাজন, নীলকর, জমিদারদের হাতে নির্যাতিত দরিদ্র ও মুসলমানদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করে । জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিতুমীরের প্রচারের ফলে দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির বহু মুসলমান দলে দলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । প্রথম প্রথম ওয়াহাবিদের সংগ্রাম ছিল স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে । কলকাতার পূর্ব ও উত্তরদিকের গ্রামসমূহ, চব্বিশ পরগনা, নদীয, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা, ফরিদপুর, মালদহ ইত্যাদি স্থানে তিতুমির অনুগামীরা জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা শুরু করে । জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তিতুমিরের বিবাদকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাদের বিবাদ বাধে । তিতুমিরের নির্দেশে প্রজারা জমিদারদের খাজনা বয়কট করে । বিদ্রোহীরা দারোগা রামরতন চক্রবর্তীকে হত্যা করে । জমিদার ও নীলকররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তিতুমিরের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট জানায় ।

তিতুমিরকে দমনের জন্য গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান । তিতুমীরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় । তিতুমীর তাঁর ৬০০ অনুগামী কাঁচা বেল, ইট, তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের উপর আঘাত হানে । ইংরেজ সেনাবাহিনীর কামানের গোলার আঘাতে তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায় । ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করেন । শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর এই সংঘর্ষে তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন । তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুম খাঁ ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন । তাঁকে কেল্লার সামনেই ফাঁসি দেওয়া হয় । এরপর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের অবসান ঘটে । প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় আরও ঘোরতর ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন ।

তিতুমিরের নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে অনেকে জমিদার-বিরোধী বা ব্রিটিশবিরোধী বা হিন্দুবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । ওয়াহাবি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলিম দরিদ্র কৃষকশ্রেণি একযোগে জমিদার ও নীলকর বিরোধিতা থেকে ব্রিটিশ বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়ে যায় । এই আন্দোলনের সুবাদে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে ভারতে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে । প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন কখনই জাতীয় আন্দোলন ছিল না এবং এই আন্দোলনের চরিত্র সাম্প্রদায়িকতা মুক্তও ছিল না । ইংরেজ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ওয়াহাবি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ।

বৈশিষ্ট্য : তিতুমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এর 'মেসিয়ানিক' (Messianic) চরিত্র । ইতিহাসে এমন এক সময় আসে যখন অসহায় নির্যাতিতরা এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন অতিমানবের আবির্ভাব প্রার্থনা করেন । অসহায় শ্রেণির মনে এক ধারণা জন্মায় যে এই সর্বশক্তিমান নেতাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর কোনো মানুষের নেই । এই ধরনের অপরিসীম ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাকেই বলা হয় 'মেসিয়ানিক' নেতা এবং তার পরিচালিত আন্দোলনকে বলা হয় 'মেসিয়ানিক' আন্দোলন ।

******

Comments

Related Items

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র ও প্রকৃতি (Characteristics of the Revolt of 1857) : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মার্চ ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে সিপাহি মঙ্গল পাণ্ডে প্রথম ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ব্যক্তির

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা (Early Stages of Collective Action) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় । এই যুদ্ধের একশো বছর পর ১

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে)

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (Peasants' Revolt in Pabna)  :- ১৯৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল্ বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা '

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt)

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt) : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেলে মুনাফালোভী ইংরেজরা দাদনের জালে আবদ্ধ করে ছলে, বলে, কৌশলে দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের নীলচ

বাংলায় ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement in Bengal)

ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement):- ঊনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফরাজি আন্দোলন । 'ফরাজি' শব্দটি আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে এসেছে । ফরজ শব্দের অর্থ হল 'আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত বাধ্যতামূলক কর্তব্য' । ইসলাম ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে হা