বাংলার নবজাগরণ -এর চরিত্র ও পর্যালোচনা

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 12/11/2020 - 19:58

ঊনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় । এই অগ্রগতি সাধারণভাবে 'ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ' নামে পরিচিত । রেনেসাঁস (Renaissance) কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল জাগৃতি বা নবজাগরণ । এর ফলে বাংলার মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন (Charter Act of 1813) চালু হওয়ার সময় থেকে নবজাগরণের পূর্ণ অগ্রগতি ঘটে । তবে এর অনেক আগে থেকেই নবজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকে । নবজাগরণের এই পূর্ব যুগকে 'নবজাগরণের বীজবপনের যুগ' বলে উল্লেখ করা হয় । ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় নতুন কাউন্সিল এবং সুপ্রিমকোর্টের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মূলত এই বীজবপনের যুগ শুরু হয় । পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতগণ অনুসন্ধানী মন ও যুক্তিতর্কের দ্বারা সবকিছুর মূল্যায়ন শুরু করেন । চিরাচরিত শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা, নীতিশাস্ত্রের ও ধর্মশাস্ত্রের নতুন মূল্যায়ন শুরু হয় । শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ সমস্ত ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় জাগরণ শুরু হয় । যা এক কথায় নবজাগরণ নামে পরিচিতি পায় । নবজাগরণ বলতে শুধু প্রাচীন দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নতুন মূল্যায়ন প্রচেষ্টাকে বোঝয় না । ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্পর্শে বাঙালি আত্মসচেতন হয়ে ওঠে । পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি পাশ্চাত্যের সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে । বাঙালি নিজের ধর্মীয় সামাজিক ত্রুটিবিচ্যুতি এবং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের চরিত্র সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে । ইতালির নবজাগরণ সঙ্গে তুলনা করে অনেকে বাংলার এই জাগরণকে 'বঙ্গীয় নবজাগরণ' বা 'Bengal Renaissance" নামে অভিহিত করেন ।

ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ মোটামুটি তিনটি ভাবধারার পথ ধরে এগিয়ে চলে । এগুলি হল— (১) পাশ্চাত্যের উদারপন্থী ভাবধারা বা পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ভাবধারা, (২) প্রাচ্যের পুনরুজ্জীবনবাদী ভাবধারা বা ঐতিহ্যবাহী ভাবধারা এবং (৩) সমন্বয়বাদী ভাবধারা ।

(১) পাশ্চাত্যের উদারপন্থী ভাবধারা বা পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ভাবধারা :- পাশ্চাত্যের উদারপন্থী ভাবধারার প্রভাবে সমাজসংস্কার, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নারীমুক্তি আন্দোলন প্রভৃতি শুরু হয় । যুক্তির আলোকে প্রচলিত প্রথা এবং আচার-বিধিগুলি যাচাই করে নেওয়ার রীতি চালু হয় । কেউ কেউ প্রাচ্যের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির উন্নতি ঘটানোর পরিকল্পনা করেন । এই ভাবধারার মুখপাত্র ছিল 'নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী' । 

(২) প্রাচ্যের পুনরুজ্জীবনবাদী ভাবধারা বা ঐতিহ্যবাহী ভাবধারা :- এই ভাবধারায় প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দিকগুলিকে তুলে ধরা শুরু হয় । বিশেষত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা ও গৌরবময় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় । সনাতনপন্থী প্রগতিশীল মানসিকতার ব্যক্তিরা এই ভাবধারার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । 

(৩) সমন্বয়বাদী ভাবধারা :- এই ভাবধারায় প্রাচীন যুগের যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা কিছু শ্রেষ্ঠ উভয়ের সমন্বয়ের উদ্যোগ শুরু হয় । বাংলা তথা ভারতের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির পথনির্দেশ ছিল এই তৃতীয় ধারার মূল বৈশিষ্ট্য । বাংলার নবজাগরণ এই সমন্বয়বাদী ভাবধারার পথ ধরেই এগিয়ে চলে । এই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ । সমালোচকদের ধারণায় উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ এলিটিস্ট (Elitist) সমাজের মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।

*****

Comments

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা