বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 02/03/2021 - 13:44

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পর্বে শ্রমিক আন্দোলন (Anti-Partition Movement and the Working Class):-

ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা না করলেও ভারতের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত শ্রমিক সম্প্রদায় প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল । ভারতে শিল্প বিকাশের ফলে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং তারা তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য মজুরি বৃদ্ধি, বিভিন্ন অন্যায়, অবিচার ও শোষণের প্রতিকার ইত্যাদির জন্য তারাও আন্দোলনে শামিল হত । কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথম দিকে তারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার কথা ভাবেনি । শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জাতীয় কংগ্রেস এবং পরবর্তীকালে বামপন্থী সংগঠনগুলি এগিয়ে আসে ।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই অক্টোবর লর্ড কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে বাংলার বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক ও মজুররা প্রতিবাদ মিছিল ও জমায়েতে যোগ দেয় ও ধর্মঘট পালন করে । স্বদেশি আন্দোলনজাত রাজনৈতিক আদর্শ, কলকারখানাগুলিতে ইউরোপীয় মালিকদের বৈষম্যমূলক নীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি শ্রমিক আন্দোলনকে গতিশীল করে তোলে । স্বদেশি আন্দোলনের সময় সরকারি ছাপাখানা, রেল, ট্রাম, কলকারখানা, চটকল, কর্পোরেশনের সর্বত্র শ্রমিক ধর্মঘট হয় । একে একে কলকাতার ট্রাম শ্রমিকরা, কলকাতা কর্পোরেশনে কুলি ও ঝাড়ুদাররা, কলকাতায় অবস্থিত ভারত সরকারের ছাপাখানার কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করে । ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে অক্টোবর বাংলার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন 'প্রিন্টার্স অ্যান্ড কম্পোজিটার্স লিগ' স্থাপিত হয় । চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কলকাতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেল শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবির জন্যে এবং বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এক সভার আয়োজন করে । ঐক্যের প্রতীক হিসেবে রাখি বন্ধন উৎসব পালন করে । ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই -এ ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের শ্রমিক কর্মচারীরা 'রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন' নামে শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে ও ধর্মঘট ডাকে । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন স্থানে রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে । ১৯০৫-০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলায় চটকলগুলিতে একাধিকবার ধর্মঘট পালিত হয় ।

তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে বাড়তি মজুরির দাবিতে ব্রিটিশ মালিকানাধীন বস্ত্র কারখানায় শ্রমিকরা সুব্রহ্মণ্যম শিব ও চিদম্বরম পিল্লাই -এর নেতৃত্বে ধর্মঘট শুরু করে । এদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলে তুতিকোরিন ও তিরুনেলভেলিতে ব্যাপক ধর্মঘট শুরু হয় । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে রাওয়ালপিন্ডির রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এবং অস্ত্র কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে । 'মারাঠা' ও 'কেশরী' এই দুই পত্রিকার সম্পাদক বালগঙ্গাধর তিলক সরকার-বিরোধী লেখার দায়ে গ্রেফতার হন । বিচারে বালগঙ্গাধর তিলককে ৬ বছরের জন্য দ্বীপান্তরিত করা হয় । তিলকের শাস্তির প্রতিবাদে বোম্বাই -এ বস্ত্র কারখানা ও রেল ওয়ার্কশপের শ্রমিকরা স্বতস্ফূর্তভাবে টানা ৬ দিন ধর্মঘট পালন করে । ব্রিটিশ সরকার প্রথমে পুলিশ ও পরে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ধর্মঘট ভেঙে দেয় ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের তুলনায় শ্রমিকদের অবদান ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ । শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতায় ব্রিটিশ সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে । সরকার কঠোর দমননীতি এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করলে বাংলার শ্রমিক আন্দোলন তার গতি হারায় । সরকারের তীব্র দমননীতির ফলে এই সময় শ্রমিকদের আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তা পরবর্তীকালের শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে প্রভাবিত করে ।  

*****

Comments

Related Items

শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

প্রশ্ন : শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কিভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল ?

উঃ- ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩৮ বছর বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনায় শ্রীরামপুর মিশনের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

প্রশ্ন : বাংলায় মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের কীরূপ অবদান ছিল ?

১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

প্রশ্ন : ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহকে কি সামন্ত-শ্রেণির বিদ্রোহ বলা যায় ?

উঃ- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকেই এই বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন ধারার ইতিহাসচর্চার নানা ধরনের গবেষণালব্দ মতামত পাওয়া যায় ।

কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

প্রশ্ন : কী উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিক সরকার অরণ্য আইন প্রণয়ন করেন ?

এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?

প্রশ্ন : এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের কীরূপ ভূমিকা ছিল ?