চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (The Permanent Settlement-1793)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 10:28

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (The Permanent Settlement- 1793)

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যয়ভার বহন করার জন্য তাঁরা রাজত্বের সূচনা থেকেই বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের দিকে মনোনিবেশ করে । ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ ও সর্বাধিক রাজস্ব আদায়ের জন্য বোর্ডের অধীনে একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন করেন । এই কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে জমি নিলামে ডেকে সর্বোচ্চ মূল্যদাতাকে পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারা দিতেন । একে পাঁচশালা বন্দোবস্ত বলা হত । অনেক সময় প্রকৃত জমিদারদের পরিবর্তে দালালরা অধিক দর দিয়ে জমিদারি নিলামে ডেকে নিতেন ও পরে দেয় রাজস্ব পরিশোধ করতেন না । ফলে সরকারি কোষাগারে তেমন আয় হত না । অগত্যা হেস্টিংস পাঁচশালা বন্দোবস্তের পরিবর্তে একশালা বন্দোবস্ত চালু করেন । এতেও সরকারের আশানুরূপ রাজস্ব আদায় হত না । কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক বছরের ইজারার শেষে জমিদাররা সরকারি রাজস্ব শোধ না করে জমিজমা ছেড়ে পালাতেন । এই অবস্থার অবসানকল্পে কাউন্সিলের জনৈক সদস্য স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস হেস্টিংসকে সর্বপ্রথম জমিতে জমিদারদের স্থায়ী ভোগদখলের স্বীকৃতি দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব দেন । হেস্টিংস এই ব্যবস্থার পক্ষপাতী থাকলেও তাঁর আমলে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয় নি । তাঁর পরবর্তী বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশ ভারতে এসে জমিদারদের জমির মালিকানা দিয়ে জমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঠিক করেন ও এই প্রস্তাব ইংল্যান্ডে কোম্পানির পরিচালক সমিতি এবং প্রধানমন্ত্রী পিট -র অনুমোদন লাভ করে । কর্ণওয়ালিশ প্রথম দশ বছরের জন্য জমিদারদের জমির মালিকানা দিয়েছিলেন । তিনি এর নাম দেন দশশালা বন্দোবস্ত । এই ব্যবস্থাই পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রুপান্তরিত হয় । ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও বেনারসে এই ব্যবস্থা চালু হয় । এই ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদার বাংশানুক্রমে জমির স্বত্ব ভোগ করবেন এবং তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব কোম্পানির কোষাগারে জমা দিতে হবে । নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তকালের মধ্যে খাজনা জমা দিতে না পারলে জমিদার জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন । বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে রাজস্ব পরিশোধ করতে হত বলে একে সূর্যাস্ত আইন ও বলা হয় ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে,

(১) এই ব্যবস্থার ফলে এতদিন পর্যন্ত কোম্পানির রাজস্ব সম্পর্কে যে অনিশ্চয়তা ছিল তার অবসান হয় ।

(২) কোম্পানি তার স্থায়ী আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হয় ।

(৩) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতে রাজকীয় অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা সরকারের প্রধান সমর্থক ছিলেন । এদের সহযোগিতায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব ও বিস্তার ঘটতে থাকে ।

(৪) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংগৃহীত অর্থ থেকে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক বিনিয়োগের মূলধন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় ।

(৫) জমিদারগণ স্থায়ীভাবে জমির মালিকানা পাওয়ার জন্য কৃষিজমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় । কৃষির উন্নতি ঘটে, ফলে জমি থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বাবদ আয় ক্রমশ বাড়তে থাকে ।

(৬) কোম্পানি তার স্থায়ী আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের পক্ষে বাৎসরিক আয়ব্যয়ের একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা সহজ হত ।

(৭) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে প্রজারা নীলামদারদের শোষণ ও ঘন ঘন উচ্ছেদের হাত থেকে রেহাই পায় ।

(৮) এই বন্দোবস্তের ফলে জমিদারগণ অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের মধ্যমণি হয়ে গ্রামগুলির সর্বাঙ্গীন উন্নতির প্রতি যত্নবান হয়েছিলেন ।

(৯) কালক্রমে এই জমিদার শ্রেণির মধ্যে থেকেই জাতীয় সংগ্রামের পুরোধা বহু নেতার আবির্ভাব হয়েছিল । তাঁদের দ্বারা বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণ ত্বরান্বিত হয় ।

(১০) মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ও এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আর একটি সুফল । 

(১১) দেশের কৃষিযোগ্য আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভূমি ও সমাজব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল । ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষায় দেড়শো বছরের ব্রিটিশ শাসনের এটাই একমাত্র ব্যবস্থা যা ভারতীয় জনসাধারণের আর্থিক কল্যাণ সাধন করেছে । ঐতিহাসিক মার্শম্যানের ভাষায় কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি সাহসিকতাপূর্ণ বিজ্ঞ পদক্ষেপ । তিনি বলেছেন  ‘It was a bold, brave and wise measure’ ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল 

(১) এই ব্যবস্থায় জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছিল । প্রজাদের স্বার্থ দেখা হয় নি ।

(২)  ভূমিহীন প্রজাগণ অত্যাচারী জমিদার ও নায়েবদের খপ্পরে পড়ে তাদের দুর্দশার শেষ ছিল না ।

(৩)  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মানুষ জমির উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ও শিল্পের অগ্রগতি রুদ্ধ হয় । ফলে ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেওয়ায় গ্রাম বাংলার দারিদ্র আরও বাড়তে থাকে ।

(৪)  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে জমিদার ও প্রজা উভয়কেই টাকার জন্য বিত্তবানদের কাছে হাত পাততে হত । এইভাবে সমাজে মহাজন তথা সুদখোর সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়  ।

(৫) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে একবার খাজনার পরিমাণ নির্ধারিত হলে সেই খাজনাই চলে আসত । কৃষির উন্নতির ফলে জমিদারদের আয় বাড়লেও সরকার তার অংশ থেকে বঞ্চিত হত ।

*****

Related Items

দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক

ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় জুড়ে সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষ উপেক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত । সমাজের তথাকথিত ওপর তলার উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গের শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুর হাল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের করায়ত্ত করে রাখত । নিচু তলার মানুষ ভীত, ...

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ

বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ(Development of Dalit Politics and Movements in Twentieth Century India):-

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী যে জাতীয় আন্দোলনগুলি সংঘটিত হয় তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি জাতীয় আন্দ

বীণা দাস (Bina Das)

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলার বিপ্লবী বীণা দাস । তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে আগস্ট নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল চট্টগ্রামে । তাঁর পিতার নাম বেণী মাধব দাস ও মাতার নাম সরলা দাস ...

মাস্টারদা সূর্যসেন (Surya Sen)

ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত । তাঁর ডাকনাম ছিল কালু । সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম রাজমনি সেন এবং মায়ের নাম শশীবালা সেন ...

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers)

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (Bengal Volunteers):-

গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডাকা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' সংগঠনটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয়