ক্রিপসের দৌত্য (Cripps Mission)

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/24/2012 - 08:36

ক্রিপসের দৌত্য (Cripps mission) :

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিলে যুদ্ধের গতি নতুন দিকে মোড় নেয় । ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি সেভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করে এবং জাপান মিত্র-শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে চলে যায় ।

(ক) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা কারণে জটিল হয়ে ওঠে । এই সময়ে একদিকে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী বিস্ফোরক পরিস্থিতি হয় ও অন্য দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়ার নানা অঞ্চলে জাপানের অভাবনীয় সাফল্য, বিশেষ করে মালয়, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) রাজধানী রেঙ্গুনের পতন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে ।

(খ) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জয় করে জাপান বার্মার ভিতর দিয়ে দ্রুত ভারতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারেন যে, এই সংকটের সময় ভারতবাসীর সাহায্য ছাড়া ভারতে জাপানকে বাধা দেওয়া যাবে না । আর ভারতে ব্রিটিশ অধিকার রক্ষা করা যাবে না । জাপানি আক্রমণের ফলে উদ্ভূত এই জটিল পরিস্থিতিতে এশিয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গনে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলা করতে হলে ভারতের সামরিক শক্তি ও সম্পদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন ।

(গ) ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় ৬৫% সৈন্য ছিল অমুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত । জাপানি আক্রমণের আগে ব্রিটিশ সরকারের ধারণা ছিল এই যে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সেই সময়ের প্রতিনিধি কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মুসলিম লিগ দলের সাহায্যেই এদেশে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি হবে । কিন্তু জাপানি আক্রমণের ভয় তাদের সেই ভ্রান্ত মনোভাবের পরিবর্তন ঘটায় । তারা বুঝতে পারে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা পেতে হলে মুসলিম লিগের তুলনায় কংগ্রেসের সমর্থন লাভই বেশি প্রয়োজন ।

(ঘ) তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ব্রিটিশ সরকারকে ভারত সম্পর্কে নরম মনোভাব নিতে বাধ্য করে । এই সময়ে চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই শেক ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেন্ট উভয়েই ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নীতি পরিবর্তনের অনুরোধ জানান । এরই সঙ্গে সঙ্গে আটলান্টিক সনদে পরাধীন জাতিগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল । সেই অর্থে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ভারতের পক্ষে অনুকূল ছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতবর্ষ ও বিশ্ব রাজনীতির এই জটিল প্রেক্ষাপটে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ও ভারতীয়দের আস্থাভাজন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে ভারতে পাঠান ।

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস -এর ভারতে আসার উদ্দেশ্য :-

(ক) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিপর্যয় মোকাবিলায় ভারতীয়দের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ এবং

(খ) ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান ও শাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে ভারতীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসেছিলেন ।

ক্রিপসের প্রস্তাব :-  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে মার্চ স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতে এসে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর একগুচ্ছ প্রস্তাব ঘোষণা করেন । তিনি মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সহ অন্যান্য দলের নেতৃবর্গের সঙ্গে দীর্ঘ্য আলাপ-আলোচনার পর নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি পেশ করেন —

(১) যুদ্ধের অবসানে ভারতকে কানাডার মতো অধিরাজ্যের মর্যাদা (Dominion Status) দেওয়া হবে ।

(২) যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠন করা হবে এবং সেই সভাকে ভারতের নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হবে ।

(৩) নতুন সংবিধান কোনো প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশ ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী সংবিধান রচনা করতে পারবে । ভারতের যে কোনো প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও থাকতে পারবে ।

(৪) সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ-ব্যবস্থা বহাল রাখা ।

(৫) প্রদেশগুলির প্রাদেশিক আইনসভা সংবিধান সভার সদস্যদের নির্বাচন করবে, অন্যদিকে দেশীয় রাজ্যের রাজারা তাঁদের সদস্যদের মনোনীত করবেন ।

(৬) নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিজের হাতে রাখবে এবং বড়লাটের কার্যনির্বাহক কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘ভিটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বাতিল করার অধিকার বড়লাটের থাকবে ।

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ :

ক্রিপসের প্রস্তাবগুলি ভারতের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ—

(ক) ক্রিপসের প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছার অভাব প্রকাশ পায়, তাই কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ সহ ভারতের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ক্রিপস- এর প্রস্তাব একযোগে প্রত্যাখ্যান করে ।

(খ) এই প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবিকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় অর্থাৎ ক্রিপস প্রস্তাবে দেশ বিভাগের পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকায় কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে । গান্ধিজি বলেন এটি একটি ফেল করা ব্যাঙ্কের তামাদি চেক (a post-dated cheque on a crushing Bank) ।

(গ) ভারতের প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার রাজি ছিল না ।

(ঘ) ক্রিপস প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারকে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার মতো সম-মর্যাদা ও ক্ষমতা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না ।

(ঙ) মুসলিম লিগ ক্রিপস প্রস্তাবে আপাত খুশি হলেও সরাসরি দেশ বিভাগ মেনে না নেওয়ায় তা বর্জন করে । ফলে ক্রিপস তাঁর প্রস্তাব সমূহ প্রত্যাহার করে দেশে ফিরে যান ।

*****

Related Items

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল ?

প্রশ্ন:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল ?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে নানা পরিবর্তন ঘটে—

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল ?

প্রশ্ন:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে কী কী পরিবর্তন ঘটেছিল ?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা কীরূপ ছিল ? ইতালিতে ও জার্মানিতে গণতন্ত্রের পতন হয় কেন ?

প্রশ্ন:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা কীরূপ ছিল ?  ইতালি ও জার্মানিতে গণতন্ত্রের পতন হয় কেন ?

মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনে আর্যবান্ধব সমাজ ও অভিনব ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:-  মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলনে আর্যবান্ধব সমাজ ও অভিনব ভারতের ভূমিকা আলোচনা কর ।

ক্ষুদিরাম বসু ও লালা হরদয়ালকে মনে রাখা হয় কেন ?

প্রশ্ন :-  ক্ষুদিরাম বসু ও লালা হরদয়ালকে মনে রাখা হয় কেন ?

ক্ষুধিরাম বসুকে মনে রাখার কারণ :