কংগ্রেসে বামপন্থী চিন্তাধারার বিকাশ

Submitted by avimanyu pramanik on Tue, 04/24/2012 - 08:29

কংগ্রেসে বামপন্থী চিন্তাধারার বিকাশ (Growth of Socialist Ideas within the Congress) :

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার তাসখন্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি' প্রতিষ্ঠা হলেও ভারতে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে ওঠেনি । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের ১ তারিখে হিন্দুস্তান লেবার কিষান পার্টির বিশিষ্ঠ কমিউনিস্ট নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ভারতে প্রথম মে দিবস পালন করেন । ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরের সম্মেলনে মোজাফফর আহমেদ ‘ভারতীর কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন । দেশে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বামপন্থী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেখা দেওয়ায় বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জাতীয় কংগ্রেসের ভেতরে ও বাইরে বামপন্থী ঝোঁক প্রকট হয়ে উঠেছিল । এই সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে একটি বামপন্থী মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠির আত্মপ্রকাশ ঘটে । এদের নেতৃত্বে ছিলেন দুই তরুণ নেতা জওহরলাল নেহরুসুভাষচন্দ্র বসু । এঁরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এতাবত্কাল গৃহীত নীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং দেশের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে আরও কঠোর মনোভাব গ্রহণের কথা প্রায়ই ব্যক্ত করতেন । এই দু জনের মধ্যে বেশি সরব ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু । তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তি অর্জনের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি জাতীয় আন্দোলনকে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন । সে জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে এক সমান্তরাল সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন । সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহেরু প্রমুখ নবীন নেতারা জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন । তাঁরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থাৎ বিদেশি শাসনের অবসান ঘটানোকে চরম লক্ষ বলে মনে করেছিলেন এবং সেই সঙ্গে তাঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটানো প্রয়োজনীয় কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন ।

গান্ধিজির আহ্বানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে সুভাষচন্দ্র বসু অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন । তার অব্যাহতি পর থেকেই কংগ্রেসের অনুসৃত নীতি, মত ও পথ নিয়ে তাঁর সঙ্গে গান্ধিজির প্রায় মতপার্থক্য লেগে থাকত । এই মতপার্থক্য সত্ত্বেও ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের পরিপেক্ষিতে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন । এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয় । সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশকে কখনই ভারতীয় সম্পদ ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত হবে না । বরং ব্রিটিশ সংগ্রামে লিপ্ত হলে সেই সময় তাঁদের চরম আঘাত হানা প্রয়োজন, যাতে তাঁরা ভারতবাসীর স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় । ব্রিটিশ একদিকে গণতান্ত্রিক শক্তির সপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ, অন্যদিকে সেই ব্রিটিশই আর একটি দেশের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কোনোরূপ মর্যাদা দিচ্ছেন না— এই দ্বিচারিতা সুভাষচন্দ্র বসু মেনে নিতে পারেন নি । গান্ধিজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতের বিরোধী ছিলেন । গান্ধিজি সর্বাগ্রে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি তুলে সুভাষচন্দ্র বসুর পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন । অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক পুনর্গঠনেও গান্ধিজি মত পোষণ করতেন ।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ত্রিপুরিতে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে । কংগ্রেসের নবীন সম্প্রদায়ের অনুরোধে সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতির পদপ্রার্থী হন । এবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গান্ধিজির মনোনীত এবং সমর্থিত পট্টভি সীতারামাইয়া । নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন । ক্ষুব্ধ গান্ধিজি সদলবলে অধিবেশন ত্যাগ করেন । এরপর সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধিজির ইচ্ছার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল কংগ্রেস সভাপতি থাকা সমীচীন নয় বলে মনে করেন । তাই কংগ্রেসের স্বার্থে তিনি কংগ্রেসের সভাপতির পদ ত্যাগ করে কংগ্রেসের মধ্যেই তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মে একটি দল গঠন করেন । এই নতুন দলের নাম দেন ফরোয়ার্ড ব্লক । সুভাষ চন্দ্র বসু চেয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরের ও বাইরের বামপন্থী শক্তি গুলিকে সুসংহত করে একটি সংগ্রামী মঞ্চে পরিণত করা । এ জন্য তিনি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ফরওয়ার্ড ব্লক ও কয়েকটি বামপন্থী গোষ্ঠীকে নিয়ে বামপন্থী সমন্বয় কমিটি গঠন করেন । এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সুভাষ চন্দ্রের বিরদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁকে বাংলা কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কৃত করা হয় এবং তিন বছরের জন্য কংগ্রেসের কোনো পদ গ্রহণের অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হয় । সুভাষ চন্দ্র বসুর আধিপত্য হ্রাস করার জন্য বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় । অচিরেই সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ফরোয়ার্ড ব্লক একটি স্বতন্ত্র দলের মর্যাদা লাভ করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল ।

১৯৩৯ সালের মে মাসে মহাত্মা গান্ধির মতাদর্শের বিরোধী ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেসের কিছু যুবক সদস্যদের উদ্যোগে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভব হয় । কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের কয়েকজন নেতা হলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পটবর্ধন, ইউসুফ মেহেরালি প্রভৃতি । কংগ্রেসে সমাজতন্ত্রী দলের উদ্ভবের কারণগুলির মধ্যে নিম্নলিখিত কারণগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে । বিংশ শতকের তিরিশের দশকে জাতীয় কংগ্রেসে

(ক) রুশ বিপ্লবের প্রভাব এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রাধান্য,

(খ) শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশায় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের উদাসীনতা,

(গ) কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব,

(ঘ) সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী সুভাষচন্দ্র বসু ও জহরলাল নেহেরুর প্রভাব প্রভৃতি কারণে কংগ্রেসের মধ্যে একটি বাম মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠির আত্মপ্রকাশ ঘটে ।

*****

Related Items

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ (Students' Role in Armed Revolutionary Struggles) :-

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাধীন জাতির মুক্তি সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও জাতীয

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day)

রশিদ আলি দিবস (Rasid Ali Day) :-

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি লালকেল্লার সামরিক আদালতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে কোর্ট মার্শাল করে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে এই অবিচারের প্রতিবাদে ও তাঁর মুক্তির দাবিতে

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Quit India Movement) :-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ড

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

আইন অমান্য আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Civil Disobedience Movement):-

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলে সেই আন্দোলনে ভারতের ছাত্রসম

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জা