উনিশ শতকের বাংলার 'নবজাগরণ' ধারণার ব্যবহার বিষয়ক বিতর্ক

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 12/12/2020 - 10:34

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় কেউ কেউ তাকে 'নবজাগরণ' বলে অভিহিত করেছেন । প্রকৃত অর্থে এই অগ্রগতিকে নবজাগরণ বলা যায় কি না তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও পন্ডিতমহলে বিতর্কের শেষ নেই । ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ঊনিশ শতকের অগ্রগতিকে 'নবজাগরণ' বলে স্বীকার করে নিয়েছেন । স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর 'History of Bengal' গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে উনিশ শতকের বাংলার অগ্রগতিকে নির্দ্বিধায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলে অভিহিত করেছেন । তিনি লিখেছেন, "ইংরেজদের দেওয়া সব থেকে বড়ো উপহার আমাদের ঊনিশ শতকের নবজাগরণ । এটি যথার্থই একটি নবজাগৃতি । কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর ইউরোপে যে নবজাগরণ দেখা দেয়, ঊনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণ ছিল তার চেয়ে অধিক ব্যাপক ও বৈপ্লবিক ।" অধ্যাপক সুশোভন সরকার তাঁর 'নোটস অন বেঙ্গল রেনেসাঁস' শীর্ষক গ্রন্থে নবজাগরণের নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন । বাংলার এই সাংস্কৃতিক জাগরণকে নবজাগরণ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের নবজাগরণে ইতালির যেরূপ ভূমিকা ছিল উনবিংশ শতকে ভারতের নবজাগরণে বাংলার অনুরূপ ভূমিকা ছিল । ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর লেখায় বাঙালির জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণের সূচনা ঘটেছিল তা স্বীকার করেছেন ।

ড. অমলেশ ত্রিপাঠী'র মতে বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট ও প্রকৃতির সঙ্গে ইতালির নবজাগরণের বিশাল পার্থক্য ছিল । দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের বাণিজ্যবিপ্লব, নগরবিপ্লব যেভাবে ইতালির নবজাগরণের পটভূমি প্রস্তুত করেছিল, বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না । ইতালীয় নবজাগরণের কেন্দ্র ফ্লোরেন্সে ছিল স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ । অপরদিকে বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র কলকাতা ছিল বিদেশি ব্রিটিশ শাসকের শাসনাধীন । তাই স্বাধীন ফ্লোরেন্স নগরী শিল্পীদের যেভাবে বরণ করে নিয়েছিল, কলকাতা তা পারেনি । কিছু জমিদার, কোম্পানির বেনিয়ান, দেশীয় গোমস্তা ও কিছু চাকরিজীবী কলকাতায় নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন । অপরদিকে কসিমো বা লোরেঞ্জো মেদিচির মতো ধনী ব্যাংক ব্যবসায়ীগণ ফ্লোরেন্সে নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষকতা করেন । অধ্যাপক সুমিত সরকার বাংলার নবজাগরণকে ইংরেজদের নকলনবিশি বলে সমালোচনা করেছেন । বিনয় ঘোষের মতে বাংলার নবজাগরণ একটি অতিকথা মাত্র । তিনি এই নবজাগরণকে ঐতিহাসিক প্রতারণা (Historical Hoax) বলে সমালোচনা করেছেন । তিনি বলেন "নবজাগরণ হয়নি, যা লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হয়, তা অতিকথা মাত্র ।" অম্লান দত্ত বলেছেন বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকলেও উনিশ শতকে নবজাগরণের যথেষ্ট অবদান ছিল । সেন্সাস কমিশনার অশোক মিত্র ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের সেন্সাস রিপোর্টে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে 'তথাকথিত নবজাগরণ' (So-called Renaissance) বলে উল্লেখ করেছেন ।' কারণ এই জাগরণ ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং এটি পরজীবী ভূস্বামীশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।

*****

Comments

Related Items

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ । কী কারণে শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়ে ছিল ?

প্রশ্ন:-  আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখ । কী কারণে শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়ে ছিল ?

আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান—

’করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে’ -কোন আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল ? এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকরা কীরূপ ভূমিকা নিয়েছিল ?

প্রশ্ন:-  ’করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে’ -কোন আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল ? এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকরা কীরূপ ভূমিকা নিয়েছিল ?

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল 'করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গে' ।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসার আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রসার আলোচনা কর ।

১৯৪২ সালের ৮ই আগষ্ট ‘ভারত-ছাড়ো প্রস্তাব’ গৃহীত হলে পরদিন অর্থাৎ ৯ই আগষ্ট, ১৯৪২ এর ভোর থেকেই আন্দোলন শুরু হয়, যেমন—

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কোন ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে স্যার স্ট্যাস্ট্যাস্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স ভারতে এসেছিলেন ?

প্রশ্ন:-  ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কোন ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স ভারতে এসেছিলেন ?

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান আলোচনা কর ।

প্রশ্ন:- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান আলোচনা কর ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাতঙ্গিনী হাজরার অবদান বিশেষভাবে স্মরনীয় ।