অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 02/14/2021 - 16:01

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্বে ছাত্র আন্দোলন (Students' Participation in the Non Co-operation Movement):-

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দমনমূলক রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসন প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে গান্ধিজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে তাতে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ছাত্র অংশ গ্রহণ করে । গান্ধিজি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের আহ্বান জানান । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্বর লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে নাগপুরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কলেজ ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে লালা লাজপত রায় ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেন । তিনি বলেন ছাত্র বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্রদের অবশ্যই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত ।

সরকারি স্কুলকলেজ বয়কট করে ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয় । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি স্বরাজের দাবিতে কলকাতার সমস্ত স্কুলকলেজে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয় । এই ধর্মঘট উপলক্ষে মির্জাপুর (বর্তমান শ্রদ্ধানন্দ স্কোয়ার) স্কোয়ারে প্রায় ৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর সমাবেশে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছাত্রদের দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত করেন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি গান্ধিজি কলকাতায় ন্যাশনাল কলেজ উদ্বোধন করার জন্য এলে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার ছাত্র সমাজের ভূমিকা দেখে বলেন— "ছাত্রদের কাছে এর থেকে কিছু কম আশা করিনি । আমি আশা করি তোমরা আরও অনেক বেশি সাড়া দেবে । বাংলার ছাত্রসমাজই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে, এ বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই ।"

হাজার হাজার ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিদেশি বস্ত্র ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং শুরু করে । 'প্রিন্স অব ওয়েলস' ভারত সফরে এলে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ছাত্ররা যুবরাজের যাত্রাপথের দুপাশে কালো পতাকা হাতে নিয়ে 'স্বাধীন ভারতের জয়', 'যুবরাজ ফিরে যাও' ধ্বনি দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । কলকাতা ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, মেদিনীপুরে অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । গুণধর হাজরা, শ্রীপতিচরণ কয়াল ও সতীশচন্দ্র সামন্ত প্রমুখ ব্যক্তিদের পরিচালনার দায়িত্বে তমলুক মহকুমার মহিষাদলে এক জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে । ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তরুণ ছাত্র ধীরেন দাশগুপ্তের উদ্যোগে এবং আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে 'ক্যালকাটা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন' গঠিত হয় ।

বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম -সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে শামিল হয় । এই সময় কলেজ স্তরে ৫২ হাজার ৪৮২ জন এবং মাধ্যমিক স্তরে ১২ লক্ষ ৮১ হাজার ৮১০ জন ছাত্র সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বয়কট করে বলে ব্রিটিশ সরকারের এক গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে জানা যায় । অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে বেশ কিছু স্বদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন— জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, কাশী বিদ্যাপীঠ, বিহার বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠে । ড. জাকির হোসেন, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, লালা লাজপত রায়, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ শীর্ষ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অধ্যাপনার দায়িত্ব নেন । আই সি এস পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু সরকারি চাকরি ছেড়ে জাতীয় মহা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন ।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছাত্র আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠলেও ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরা গ্রামে উত্তেজিত জনতা থানার ২২ জন পুলিশকে পুড়িয়ে মারলে গান্ধিজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয় । ফলে ছাত্র আন্দোলন ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে ও এক সময় আন্দোলন থেমে যায় ।   

*****

Comments

Related Items

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

কাশ্মীর রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Kashmir):-

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দু

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি

হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তি (Annexation of Hyderabad):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' -এ বলা হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের সম্পাদিত চুক্তির পরিসমাপ্তি ঘটবে ।

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক (Initiatives Undertaken and Controversies Related to the Accession of Princely State with India):-

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখণ

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪)

উত্তর ঔপনিবেশিক ভারত : বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (১৯৪৭ - ১৯৬৪) [Post-Colonial India : Second Half od the 20th Century (1947-1964)]:-

দীর্ঘদিনের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও আত্মবলিদানের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের 'ভারতের স্বাধীনতা

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন

হিন্দু জাতিভুক্ত নিম্নবর্গীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার উল্লেখযোগ্য দলিত হিন্দু সম্প্রদায় । নমঃশূদ্ররা হিন্দু জাতিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত । নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল । ...