উদ্ভিদের রেচন (Excretion in Plants)

Submitted by arpita pramanik on Fri, 11/23/2012 - 20:04

উদ্ভিদের রেচন (Excretion in Plants)

উদ্ভিদের রেচনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of plant excretion)

(ক)  উদ্ভিদের রেচন পদার্থগুলি প্রাণীদের তুলনায় কম জটিল এবং কম ক্ষতিকারক ।

(খ)  উদ্ভিদ দেহে বিপাকীয় ক্রিয়ার হার কম হওয়ায় এদের দেহে রেচন পদার্থও কম উত্পন্ন হয় ।

(গ) উদ্ভিদ দেহে উত্পন্ন রেচন পদার্থগুলির অধিকাংশই উপচিতি-বিপাকের মাধ্যমে বিভিন্ন কোশীয় দ্রব্যে সংশ্লেষিত হয় ।

(ঘ)  উদ্ভিদের রেচন পদার্থগুলির অধিকাংশই কোষে কেলাস বা কলোয়েড হিসাবে সঞ্চিত থাকে ।

(ঙ)  উদ্ভিদ দেহে কোনো নির্দিষ্ট রেচন অঙ্গ বা তন্ত্র না থাকায় প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরা কিন্তু রেচন পদার্থ দেহ থেকে নির্গত করতে পারে না ।

উদ্ভিদের রেচন পদার্থ ত্যাগের পদ্ধতি (Means of Removal of Excretory Products in Plants)

কয়েকটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোনও কোনও উদ্ভিদ রেচন পদার্থ ত্যাগ করে, যেমন:

[i] পত্রমোচন:- পর্ণমোচী উদ্ভিদ, যেমন: শিমুল, শিরিষ, আমড়া, অশ্বত্থ ইত্যাদি বছরের নির্দিষ্ট ঋতুতে পত্রমোচন করে পাতায় সঞ্চিত রেচন পদার্থ ত্যাগ করে । বহু বর্ষজীবী চিরহরিৎ উদ্ভিদেরা সারা বছর ধরে অল্পবিস্তর পাতা ঝরিয়ে রেচন পদার্থ ত্যাগ করে ।

[ii] বাকল মোচন:-  কোনও কোনও উদ্ভিদ যেমন: অর্জুন, পেয়ারা, ইত্যাদি গাছ বাকল বা ছাল মোচনের মাধ্যমে ত্বকে সঞ্চিত রেচন পদার্থ ত্যাগ করে ।

[iii] ফল মোচন:- লেবু, তেঁতুল, আপেল ইত্যাদি ফলের ত্বকে বিভিন্ন জৈব অ্যাসিড (যেমন; সাইট্রিক অ্যাসিড, টারটারিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড) রেচন পদার্থ হিসাবে সঞ্চিত থাকে । ওই সব উদ্ভিদ পরিণত ফল মোচন করে দেহ থেকে রেচন পদার্থ অপসারণ করে ।

উদ্ভিদের বিভিন্ন রেচন পদার্থ এবং তাদের অর্থকরী গুরুত্ব (Types of Excretory Products and their economic importance in Plants)

(A) নাইট্রোজেনবিহীন রেচন পদার্থ:-

[i] গঁদ বা গাম [Gums]:- গঁদ জলে দ্রবণীয় এক রকম বর্জ্য পদার্থ । সাধারণত সেলুলোজ দ্বারা গঠিত উদ্ভিদের কোষ প্রাচীর বিনষ্ট হলে গঁদ উত্পন্ন হয় । প্রাকৃতিকভাবে বা কোনও আঘাতের ফলে গঁদ উদ্ভিদের কান্ড ও শাখার বাকল থেকে নিঃসৃত হয় ।

উৎস:- সজিনা, আমড়া, শিরিষ, জিওল, বাবলা, শিমূল প্রভৃতি গাছের ছাল বা বাকল থেকে গঁদ নিঃসৃত হয় ।

অর্থকরী গুরুত্ব:- গঁদ বিভিন্ন শিল্পে, বিশেষ করে কাষ্ঠশিল্প এবং বই বাঁধাই-শিল্পে আঠা হিসাবে ব্যবহৃত হয় । জুতা তৈরি ও মেরামতিতে গঁদ আঠা হিসাবে ব্যবহৃত হয় । কর্পুর পায়েস, মিষ্টান্ন ইত্যাদি প্রস্তুতিতে গঁদ ব্যবহৃত হয় ।

[ii] রজন বা রেজিন [Resins]:- রজন ঈষৎ হলুদ রংয়ের জলে অদ্রবণীয় এক ধরনের জটিল বর্জ্য পদার্থ । রজন তিন রকমের হয় । যথা:-

(ক) কঠিন রজন [Hard resin] : চাঁচ গালা এই রকম রজনের উদাহরণ । এই রকম রজন অ্যালকোহলে দ্রবণীয় ।

(খ) ওলিও রজন [Oleo resin]: তরল রজন । টারপেনটাইন এই রকম রজনের উদাহরণ ।

(গ) গঁদ রজন [Gum resin]: এই রকম রজন গঁদের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে, তাই অর্ধ-তরল এবং আঠাল । ধুনা, হিং ইত্যাদি গঁদ রজনের উদাহরণ ।

উৎস [Source]:- রজন সাধারণত পাইন গাছের কান্ড, শাখাপ্রশাখা ও পাতার রজন নালীতে সঞ্চিত থাকে । প্রাকৃতিকভাবে বা কোনও আঘাতের ফলে রজন উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ থেকে নিসৃত হয় । শাল গাছের বাকলে ধুনো সঞ্চিত থাকে ।  হিং পাওয়া যায় উক্ত গাছের ছালে ।

অর্থকরী গুরুত্ব:- গালা , টারপেনটাইন ভার্নিশ শিল্পে অর্থাৎ কাঠ রং করতে ও পালিশ করতে এবং সাবান ও ফিনাইল প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয় । ধুনা পূজা-পার্বনে ব্যবহৃত হয় । হিং মিষ্টান্ন, পায়েস তৈরিতে ও মশলা রূপে ব্যবহৃত হয় ।

[iii] তরুক্ষীর বা ল্যাটেক্স [Latex]:- তরুক্ষীর প্রোটিন, গঁদ, রজন, উপক্ষার প্রভৃতি বস্তুর জলীয় মিশ্রণ । এটি উদ্ভিদের দীর্ঘ তরুক্ষীর কোষ [laticiferous cell] এবং তরুক্ষীর নালীতে [laticiferous duct] সঞ্চিত থাকে । বট, আকন্দ, পেঁপে, কাঁঠাল, রবার প্রভৃতি গাছের তরুক্ষীর সাদা দুধের মতো হয় । কলা, তামাক  প্রভৃতি গাছের তরুক্ষীর সাদা জলের মতো হয় । আফিং, শিয়ালকাঁটা  প্রভৃতি গাছের তরুক্ষীর হলুদ রং -এর হয় ।

উৎস:-  তরুক্ষীর বট, আকন্দ, পেঁপে, কাঁঠাল, রবার, ফণীমনসা, কলা, করবি, তামাক, আফিং, শিয়ালকাঁটা  প্রভৃতি গাছের তরুক্ষীর কোষে বা তরুক্ষীর নালীতে সঞ্চিত থাকে । প্রাকৃতিকভাবে বা কোনও আঘাতের ফলে ওই সমস্ত উদ্ভিদের কোনো অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হলে তরুক্ষীর নিসৃত হয় ।

অর্থকরী গুরুত্ব:-  হিভিয়া ব্রাসিলিয়েনসিস (Hevea brasiliensis) নামে প্যারা-রবার গাছের তরুক্ষীর থেকে বাণিজ্যিক রবার প্রস্তুত হয়, যা থেকে টায়ার, টিউব, ইরেজার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম প্রভৃতি নানা রকমের রবারের জিনিস প্রস্তুত হয় । পেঁপে গাছের তরুক্ষীরে প্যাপাইন (Papine) নামে একরকম উৎসেচক থাকে, যা প্রোটিন পরিপাকে সহায়তা করে । উদ্ভিদদেহের তরুক্ষীর ক্ষত সরাতে সাহায্য করে ।

 

(B) উদ্ভিদের নাইট্রোজেনযুক্ত রেচন পদার্থ:-

[iv] উপক্ষার বা ক্ষারক পদার্থ বা অ্যালক্যালয়েড[Alkaloid]:-  উপক্ষার একরকমের নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগিক পদার্থ । প্রোটিন ভেঙ্গে উপক্ষার সৃষ্টি হয় । উপক্ষার জলে অদ্রবণীয় এবং কোহলে দ্রবণীয় । এটি তরল বা কঠিন —উভয় রকমেরই হতে পারে । উপক্ষার স্বাদে কষা বা তিক্ত ।

উপক্ষারের বিভিন্ন উৎস ও অর্থকরী গুরুত্ব:-

উপক্ষার উৎস অর্থকরী গুরুত্ব
১. কুইনাইন সিঙ্কোনা গাছের বাকল ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি হয় ।
২. রেসারপিন সর্পগন্ধা গাছের মূল  উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ওষুধ তৈরি হয় ।
৩. ডাটুরিন ধুতুরা গাছের পাতা ও ফল হাঁপানির ওষুধ তৈরি হয় ।
 ৪. নিকোটিন তামাক গাছের পাতা এটি মাদক দ্রব্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় ।
৫. স্ট্রিকনিন নাক্সভোমিকা বা কুঁচেলা গাছের বীজ পেটের পীড়ার ওষুধ তৈরি হয় ।
৬. মরফিন আফিং গাছের কাঁচাফলের ত্বক ব্যথা-বেদনা উপশম ও গাঢ় নিদ্রার ওষুধ তৈরি হয় ।
৭. ক্যাফিন কফি গাছের বীজ ব্যথা-বেদনা উপশমকারী ওষুধ তৈরি হয় । 
৮.অ্যাট্রোপিন বেলেডোনা গাছের মূলে ও পাতায়  রক্তচাপ বৃদ্ধিতে ও স্নায়ুকে উজ্জীবিত করতে ব্যবহার হয় 

*****

      

Related Items

গিনিপিগের দ্বি-সংকর জননের পরীক্ষা

মেন্ডেলের দ্বি-সংকর জনন প্রক্রিয়াটি প্রাণীদেহেও ঘটানো যেতে পারে । একটি বিশুদ্ধ প্রলক্ষণযুক্ত কালো (রঙ) ও অমসৃণ (রোম) গিনিপিগের সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ প্রলক্ষণযুক্ত সাদা (রঙ) ও মসৃণ (রোম) গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য জনুতে সব কালো ও অমসৃণ গিনিপিগ ...

গিনিপিগের একসংকর জননের পরীক্ষা

উদ্ভিদের মতো প্রাণীদের মধ্যেও একসংকর পরীক্ষা ঘটানো যেতে পারে । জনিতৃ জনুর একটি বিশুদ্ধ কালো গিনিপিগের সঙ্গে একটি বিশুদ্ধ সাদা গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম অপত্য জনুতে শুধু মাত্র সংকর কালো গিনিপিগের সৃষ্টি হবে এখানে কালো রঙটি সাদার ওপর প্রকট ...

মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটর গাছ নির্বাচনের কারণ

বাগানের মিষ্টি মটর গাছে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলি থাকায় মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটর গাছকে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন । মটর গাছ দ্রুত বংশবিস্তারে সক্ষম, তাই অল্প সময়ের মধ্যে বংশানুক্রম কয়েকপুরুষ ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব । মটর ফুল উভলিঙ্গ হওয়ায় মটর ...

মেন্ডেলের দ্বিসংকর পরীক্ষা

একই প্রজাতিভুক্ত দু'জোড়া বিকল্প চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দু'টি জীবের সংকরায়ণ কে দ্বিসংকর জনন বা ডাই-হাইব্রিড ক্রস বলে । দ্বি-সংকর জননের পরীক্ষা থেকে মেন্ডেলের ধারণা হয়েছিল, জনিতৃ জনুর বৈশিষ্ট্যগুলি যে শুধুমাত্র অপত্য জনুতে আলাদাভাবে সঞ্চারিত হয় তাই নয়, উপরন্তু এই ...

মেন্ডেলের এক সংকর পরীক্ষা

একই প্রজাতিভুক্ত বিপরীতধর্মী এক-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে যে যৌন জনন সম্পন্ন হয়, তাকে একসংকর জনন বা মনোহাইব্রিড ক্রস বলে । দুটি পৃথক পরীক্ষার সাহায্যে একসংকর পরনিষেক ব্যাখ্যা করা হল, একসংকর পরীক্ষা থেকে মেন্ডেল নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন ...