সুলতানি যুগের সাহিত্য

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 09/27/2014 - 10:26

সুলতানি যুগের সাহিত্য (Literature during the Sultanate Period) :

ভারতে ইসলামি শাসন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে স্বাভাবিক কারণেই সংস্কৃত ও অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় ভাষা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে । প্রশাসনের ভাষা হিসাবে ফারসি ভাষার ব্যবহার শুরু হয় । ফলে সংস্কৃতসহ প্রাচীন ভারতীয় ভাষাগুলির চর্চা অনেক হ্রাস পায় । সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা অবশ্য একেবারে বিলুপ্ত হয়নি । রূপ গোস্বামীর ‘ললিতমাধব’ ও ‘বিদগ্ধমাধব’ এই সময়ে রচিত হয় । মধ্যযুগে ফারসির পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে । প্রধানত দুটি কারণে এই উন্নতি সম্ভব হয়েছিল ।

(১) আঞ্চলিক শাসকগন স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন । এঁদের অনেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার;

(২) ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তাগণ স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁদের বাণী ও উপদেশ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন । তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, সাধারন মানুষের কাছে যেতে হলে সংস্কৃত, আরবি বা ফারসি নয়, আঞ্চলিক ভাষাই ব্যবহার করতে হবে ।

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য : সুলতানি ও মুঘল উভয় আমলেই ফারসি ছিল রাজভাষা । এই ভাষা গোড়া থেকেই দিল্লির শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল । কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস ও রুকনউদ্দিন ছিলেন এই ভাষার পৃষ্ঠপোষক । কিন্তু আলাউদ্দিন খলজির আমলেই এই ভাষা ও সাহিত্য গৌরবের সর্বোচ্চ শীর্ষে আরোহণ করে । ঐতিহাসিক বরানির মতে, ভারতই ছিল তখন এই ভাষাচর্চার প্রধান কেন্দ্র । এই সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হলেন আমির খসরুশেখ নাজিমউদ্দিন হাসান বা হাসান-ই-দিহলাই । আমির খসরু ছিলেন একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক । তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন । এছাড়া তিনি পাঁচ লক্ষ্য শ্লোকও রচনা করেন । খসরুর বন্ধু হাসান-ই-দিহলাই ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি । সৈয়দ ও লোদি রাজারাও এই ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । শেখ জামালি কাম্বো ছিলেন এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি । দক্ষিণ ভারতের সুলতানরাও এই ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । মুঘল সম্রাটরা শুধু এই ভাষারই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না; তাঁদের অনেকেই সাহিত্য চর্চাও করতেন । বাবরের আত্মজীবনী ফারসি ভাষায় অনুদিত হয় । হুমায়ুন ও তাঁর ভাই কামরান ও বোন গুলবদন বেগম সাহিত্য চর্চা করতেন । ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে আকবরের আমল ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । পারস্যের বহু কবি তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন । আবুল ফজলের ভাই ফৈজি নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন । তাঁর তত্ত্বাবধানে ‘মহাভারত’ ফারসি ভাষায় অনুদিত হয় । উতবি ও নাজিরি ছিলেন দুজন বিখ্যাত কবি । জাহাঙ্গির, শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেবের আমলেও এই ধারা অব্যাহত ছিল । সুফি সাধকগণও এই ভাষায় তাঁদের সাহিত্য কীর্তি রেখে গেছেন । প্রসঙ্গগত উল্লেখযোগ্য অথর্ববেদ, রামায়ন, মহাভারত, যোগ উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থ এই যুগে ফারসি ভাষায় অনুদিত হয়েছিল ।

উর্দু ভাষা ও সাহিত্য : উর্দুভাষার উদ্ভব ও প্রসার হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়ের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ । আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ ও হিন্দি ভাষার ব্যাকরণ বা বাক্য রচনা পদ্ধতির সংমিশ্রণে উর্দু ভাষা গড়ে ওঠে । পারসি ও আরবি হরফের অনুকরণে এই ভাষা লেখা হয় । এই ভাষায় একজন প্রাচীন কবি হিসাবে উলদিন মামুদ শাকরগঞ্জি বা বাবা ফরিদ শাকরগঞ্জির নাম জানা যায় । কিন্তু আমির খসরু ও খোজা মহম্মদ হুসাইনির হাতেই উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল । তবে উর্দুভাষা ও সাহিত্যের যথার্থ উন্নতি ঘটেছিল দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্যে, দিল্লী বা উত্তরভারতে নয় । বিজাপুরের উর্দু লেখকদের মধ্যে শাহ মিরানজি শামগুল উলশাক ও তাঁর পুত্র বুরহানউদ্দিন জানক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । গোলকুণ্ডার সুলতানরা কেবল উর্দু ভাষার পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না; তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । মহম্মদ কুলি নামে একজন বিখ্যাত কবি ও মোল্লা ওয়াজজিও নামে একজন লেখক এই ভাষাকে সমৃদ্ধিশালী করেন ।

*****

Related Items

মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা - বাবর

ভারতে রাজ্য স্থাপন পরিকল্পনা সফল করতে বাবরকে একের পর এক নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করতে হয় । তিনটি প্রধান যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করার পর বাবরের স্বপ্ন সফল হয় । এই তিনটি যুদ্ধ হল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ ও ঘর্ঘরা যুদ্ধ । পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ...

মুঘলদের উদ্ভব ও মুঘল সাম্রাজ্য

১৫২৬ সাল থেকে ১৫৫৬ সাল পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের মুল বিষয়বস্তু মুঘল-আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা । প্রথম পানিপথের যুদ্ধে যার সূচনা, দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তার পরিসমাপ্তি । প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত করে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন । ...

দিল্লি সুলতানির পতনের কারণ

দিল্লী সুলতানের পতন অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় । জন্মলগ্ন থেকেই দিল্লি সুলতানির জীবনীশক্তি ছিল ক্ষীণ । আগাগোড়াই দিল্লি সুলতানির ভিত্তি ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত । দিল্লি সুলতানির কাঠামো ছিল স্বৈরতন্ত্র দিয়ে গড়া, যা দাঁড়িয়েছিল (আলাউদ্দিন এবং মহম্মদ বিন তুঘলকের সময় ছাড়া ) ...

সৈয়দ ও লোদি বংশ

তৈমুর দেশে ফিরে যাওয়ার আগে খিজির খান নামে একজন ব্যক্তিকে দিল্লি, মুলতান এবং দীপালপুরের শাসন ভার দিয়ে যান । এই খিজির খান তুঘলক বংশকে উচ্ছেদ করে সৈয়দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন । এই বংশের চারজন সুলতান ১৪১৪ থেকে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন । ...

তৈমুর লঙ্গের ভারত আক্রমণ

ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর দিল্লী সুলতানির পতন আসন্ন হয়ে পড়ে । ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর লঙ্গের ভারত আক্রমণ এই পতনের প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে । তৈমুর লঙ্গের ভয়ে সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যান । তৈমুরের আক্রমণ দিল্লি সুলতানির অন্তসার ...