হিমালয় দর্শন — বেগম রোকেয়া

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 07/17/2021 - 20:37

হিমালয় দর্শন  — বেগম রোকেয়া

যথা সময় যাত্রা করিয়া শিলিগুড়ি স্টেশনে আসিয়া পঁহুছিলাম । শিলিগুড়ি হইতে হিমালয় রেল রোড আরম্ভ হইয়াছে । ইস্ট ইন্ডিয়ান গাড়ির অপেক্ষা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলগাড়ি ছোটো, হিমালয়ান রেলগাড়ি আবার তাহার অপেক্ষাও ছোটো, ক্ষুদ্র গাড়িগুলি খেলনা গাড়ির মতো বেশ সুন্দর দেখায় । আর গাড়িগুলি খুব নীচু ।—যাত্রীগণ ইচ্ছা করলে চলিবার সময়ও অনায়াসে উঠিতে নামিতে পারেন ।

আমাদের ট্রেন অনেক আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করিয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠিতে লাগিল—গাড়িগুলি 'কটাটটা'—শব্দ করিতে করিতেই কখনও দক্ষিণে কখনও উত্তরে আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিল । পথের দুই ধারে মনোরম দৃশ্য—কোথাও অতি উচ্চ (step) চূড়া, কোথাও নিবিড় অরণ্য ।

ক্রমে আমরা সমুদ্র (sea level ) হইতে তিন হাজার ফিট উচ্চে উঠিয়াছি, এখনও শীত বোধ হয় না, কিন্তু মেঘের ভেতর দিয়া চলিয়াছি । নিম্ন পতাকায় নির্মল শ্বেত কুজঝটিকা দেখিয়া সহসা নদী বলিয়া ভ্রম জন্মে । তরু, লতা, ঘাস, পাতা—সকলই মনোহর । এত বড়ো বড়ো ঘাস আমি পূর্বে দেখি নাই । হরিদ্বর্ণ চায়ের ক্ষেত্রগুলি প্রাকৃতিক শোভা আরও শতগুণ বৃদ্ধি করিয়াছে । দূর হইতে সারি সারি চারাগুলি বড়ো সুন্দর বোধ হয় । মাঝে মাঝে মানুষের চলিবার সংকীর্ণ পদগুলি ধরণীর সীমান্তের ন্যায় দেখায় ! নিবিড় শ্যামল বন বসুমতীর ঘন কেশপাশ, আর পথগুলি আঁকা বাঁকা সিঁথি !

রেলপথে অনেকগুলি জলপ্রপাত বা নির্ঝর দৃষ্টিগোচর হইল—ইহার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত । কোথা হতে আসিয়া ভীমবেগে হিমাদ্রির পাষাণ হৃদয় বিদীর্ণ করিতে করিতে ইহারা কোথায় চলিয়াছে ! ইহাদেরই কোন একটি বিশালাকায় জাহ্নবীর উৎস, একথা সহসা বিশ্বাস হয় কি ? একটি বড়ো ঝরনার নিকট ট্রেন থামিল, আমরা ভাবিলাম, যাহাতে আমরা প্রাণ ভরিয়া জলপ্রবাহ দেখিতে পাই, সেই জন্য বোধহয় গাড়ি থামিয়াছে । (বাস্তবিক সেজন্য কিন্তু ট্রেন থামে নাই—অন্য কারণ ছিল । সেইখানে জল পরিবর্তন করা হইতেছিল ।) যে কারণেই ট্রেন থামুক—আমাদের মনোরথ পূর্ণ হইল ।

এখন আমরা চারি হাজার ফিট ঊর্ধ্বে উঠিয়াছি, তবু শীত অনুভব করি না, কিন্তু গরমের জ্বালায় যে এতক্ষণ প্রাণ কন্ঠাগত ছিল—সে জুলুম হইতে রক্ষা পাইলাম । অল্প অল্প বাতাস মৃদু গতিতে বহিতেছে ।

অবশেষে কারসিয়ং স্টেশনে উপস্থিত হইলাম, এখানকার উচ্চতা ৪৮৬৪ ফিট ।

স্টেশন হইতে আমাদের বাসা অধিক দূর নহে, শীঘ্রই আসিয়া পঁহুছিলাম । আমাদের ট্রাঙ্ক কয়টা ভ্রমক্রমে দার্জিলিঙের ঠিকানায় book করা হইয়াছিল । জিনিসপত্রের অভাবে বাসায় আসিয়াও (সন্ধ্যার পূর্বে) গৃহসুখ (at home) অনুভব করিতে পারি নাই ! সন্ধ্যার ট্রেনে আমাদের ট্রাঙ্কগুলি ফিরিয়া আসিল । আমাদের দার্জিলিং যাইবার পূর্বে আমাদের জিনিসপত্র তথাকার বায়ু সেবন করিয়া চরিতার্থ হইল । পরদিন হইতে আমরা সম্পূর্ণ গৃহসুখে আছি । তাই বলি, কেবল আশ্রয় পাইলে সুখে গৃহে থাকা হয় না, আবশ্যকীয় আসবাব সরঞ্জামও চাই ।

এখানে এখনও শীতের বৃদ্ধি হয় নাই, গ্রীষ্ম নাই । এ সময়কে পার্বত্য বসন্তকাল বলিলে কেমন হয় ? সূর্যকিরণ প্রখর বোধ হয় । আমাদের আসিবার পর একদিন মাত্র সামান্য বৃষ্টি হইয়াছিল । বায়ু তো খুবই স্বাস্থ্যকর, জল নাকি খুব ভালো নহে । আমরা পানীয় জল ফিলটারে ছাঁকিয়া ব্যবহার করি । জল কিন্তু দেখিতে খুব পরিষ্কার স্বচ্ছ । কূপ নাই, নদী পুষ্করিণীও নাই —সবে ধন নির্ঝরের জল । ঝরনার সুবিমল, সুশীতল জলদর্শনে চক্ষু জুড়ায়, স্পর্শনে হস্ত জুড়ায় এবং ইহার চতুষ্পার্শ্বস্থিত শীতল বাতাসে, না, ঘন কুয়াশায় প্রাণ জুড়ায় !

এখানকার বায়ু পরিষ্কার ও হালকা । বায়ু এবং মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে চমৎকার ! এই মেঘ এদিকে আছে, ওদিক হইতে বাতাস আসিল,— মেঘখণ্ডকে তাড়াইয়া লইয়া চলিল । প্রতিদিন অস্তমান রবি বায়ু এবং মেঘ লইয়া মনোহর সৌন্দর্যের রাজ্য রচনা করে । পশ্চিম গগনে পাহাড়ের গায়ে তরল স্বর্ণ ঢালিয়া দেওয়া হয় । অতঃপর খণ্ড খণ্ড সুকুমার মেঘগুলি সুকোমল অঙ্গে সুবর্ণ মাখিয়া বায়ুভরে ইতস্তত ছুটাছুটি করতে থাকে । ইহাদের এই তামাশা দেখিতেই আমার সময় অতিবাহিত হয়, আত্মহারা হইয়া থাকি, আমি কোনো কাজ করতে পারি না ।

মনে পড়ে একবার 'মহিলা'য় ঢেঁকির শাকের কথা পাঠ করিয়াছি । ঢেঁকি শাককে আমি ক্ষুদ্র গুল্ম বলিয়াই জানিতাম । কেবল ভূ-তত্ত্ব (Geology) গ্রন্থে পাঠ করিয়াছিলাম যে, কারবনিফেরাস যুগে বড় বড় ঢেঁকিতরু ছিল । এখন সেই ঢেঁকিতরু স্বচক্ষে দেখিলাম—ভারী আনন্দ হইল । তরুবর ২০/২৫ ফিট উচ্চ হইবে ।

কোনো কোনো স্থানে খুব নিবিড় বন । সুখের বিষয় বাঘ নাই, তাই নির্ভয়ে বেড়াইতে পারি, আমরা নির্জন বন্য পথেই বেড়াইতে ভালোবাসি । সর্প এবং ছিনে জোঁক আছে । এ পর্যন্ত সর্পের সহিত আমাদের সাক্ষাৎ হয় নাই । কেবল দুই তিন বার জোঁকে রক্ত শোষণ করিয়াছে ।

এদেশের স্ত্রীলোকেরা জোঁক দেখিলে ভয় পায় না । আমাদের ভুটিয়া চাকরানি 'ভালু' বলে, 'জোঁকে কি ক্ষতি করে ? রক্ত শোষণ শেষ হইলে আপনিই চলিয়া যায় । ভুটিয়ারানিরা সাত গজ লম্বা কাপড় ঘাঘরার মতো করিয়া পরে, কোমরে একখণ্ড কাপড় জড়ানো থাকে, গায়ে জ্যাকেট এবং বিলাতি শাল দ্বারা মাথা ঢাকে, পৃষ্ঠে দুই এক মন বোঝা লইয়া অনায়াসে প্রস্তর-সঙ্কুল আবুড়াখাবুড়া পথ বহিয়া উচ্চে ওঠে; ঐরূপ নীচেও যায় ! যে পথ দেখিয়াই আমাদের সাহস 'গায়েব' হয়—সেই পথে উহারা বোঝা লইয়া অবলীলাক্রমে ওঠে ।

মহিলার সম্পাদক মহাশয় আমাদের সম্বন্ধে একবার লিখিয়াছিলেন যে, 'রমণীজাতি দুর্বল বলিয়া তাঁহাদের নাম অবলা' । জিজ্ঞাসা করি, এই ভুটিয়ারানিরাও ঐ অবলা জাতির অন্তর্গত না কি ? ইহারা উদরান্নের জন্য পুরুষদের প্রত্যাশী নহে; সমভাবে উপার্জন করে । বরং অধিকাংশ স্ত্রীলোকদিগকেই পাথর বহিতে দেখি—পুরুষেরা বেশি বোঝা বহন করে না । অবলারা প্রস্তর বহিয়া লইয়া যায় । সবলেরা পথে পাথর বিছাইয়া রাস্তা প্রস্তুত করে, সে কাজে বালক বালিকারাও যোগদান করে । এখানে সবলেরা বালক বালিকার দলভুক্ত বলিয়া বোধ হয় । 

ভুটিয়ানিরা 'পাহাড়নি' বলিয়া আপন পরিচয় দেয়, এবং আমাদিগকে 'নীচেকা আদমি' বলে ! যেন ইহাদের মতে 'নীচেকা আদমি' -ই অসভ্য ! স্বভাবত ইহারা শ্রমশিলা, কার্যপ্রিয়, সাহসী ও সত্যবাদী । কিন্তু 'নীচেকা আদমি'র সংস্রবে থাকিয়া ইহারা ক্রমশ সদগুণরাজি হারাইতেছে । বাজারের পয়সা অল্পস্বল্প চুরি করা, দুধে জল মিশানো ইত্যাদি দোষ শিখিতেছে । আবার 'নীচেকা আদমি'র সঙ্গে বিবাহও হয় ! ঐরূপে উহারা অন্যান্য জাতির সহিত মিশিতেছে ।

আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড়ো একটা ঝরনা বহিতেছে; এখান হইতে ঐ দুগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায় । দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেগে প্রবাহিত হয় । বলি, প্রাণটাও কেন ঐ নির্ঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণপ্রান্তে লুটাইয়া পড়ে না ?

অধিক কী বলিব, আমি পাহাড়ে আসিয়া অত্যন্ত সুখী এবং ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়াছি । সমুদ্রের সামান্য নমুনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর দেখিয়াছি, বাকি ছিল পর্বতের একটি নমুনা দেখা । এখন সে সাধও পূর্ণ হইল ।

না, সাধ তো মিটে নাই ! যত দেখি, ততই দর্শন পিপাসা শতগুণ বাড়ে ! কিন্তু কেবল দুইটি চক্ষু দিয়াছেন, তাহা দ্বারা কত দেখিব ? প্রভু অনেকগুলি চক্ষু দেন নাই কেন ? যত দেখি, যত ভাবি, তাহা ভাষায় ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই । প্রত্যেকটি উচ্চশৃঙ্গ, প্রত্যেকটি ঝরনা প্রথমে যেন বলে, আমায় দেখ ! আমায় দেখ ! যখন তাহাকে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে দেখি, তখন তাহারা ঈষৎ হাস্যে ভ্রুকুটি করিয়া বলে, আমাকে কী দেখ ? আমার স্রষ্টাকে স্মরণ করো ! ঠিক কথা । চিত্র দেখিয়া চিত্রকরের নৈপুণ্য বুঝা যায় । নতুবা নাম শুনিয়া কে কাহাকে চিনে ? আমাদের জন্য হিমালয়ের এই পাদদেশটুকু কত বৃহৎ, কত বিস্তৃত—কী মহান ! আর সেই মহাশিল্পীর সৃষ্ট জগতে হিমালয় কত ক্ষুদ্র ! বালুকাকণা বলিলেও বড়ো বলা হয় !

আমাদের এমন সুন্দর চক্ষু, কর্ণ, মন লইয়া যদি আমরা স্রষ্টার গুণকীর্তন না করি, তবে কি কৃতঘ্নতা হয় না ? মন, মস্তিষ্ক, প্রাণ সব লইয়া উপাসনা করিলে, তবে তৃপ্তি হয় । কেবল টিয়াপাখির মতো কন্ঠস্থ কতকগুলি শব্দ উচ্চারণ করলে (অন্তত আমার মতে) উপাসনা হয় না । তদ্রুপ উপাসনায় প্রাণের আবেগ থাকে কই ? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শনকালে মন প্রাণ স্বতঃই সমস্বরে বলিয়া উঠে, 'ঈশ্বরই প্রশংসার যোগ্য । তিনিই ধন্য !' তখন এসব কথা মুখে উচ্চারণের প্রয়োজনও হয় না ।

(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

****

Comments

Related Items

'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে দুই রক্ষীর কথাবার্তায় সমাজের কোন ছবি ফুটে উঠেছে তা লেখ ।

প্রশ্ন : 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে দুই রক্ষীর কথাবার্তায় সমাজের কোন ছবি ফুটে উঠেছে তা লেখ

'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে রাজশ্যালকের ভূমিকা নির্দেশ কর ।

প্রশ্ন : 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে রাজশ্যালকের ভূমিকা নির্দেশ কর ।

উঃ মহাকবি কালিদাসের লেখা 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' নাটকের ষষ্ঠ অঙ্ক থেকে 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশটি নেওয়া হয়েছে । বাংলায় এটির তরজমা করেছেন সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী ।

'নোঙর' কীসের প্রতীক তা বুঝিয়ে দাও ।

প্রশ্ন: 'নোঙর' কীসের প্রতীক তা বুঝিয়ে দাও

'নোঙর' কবিতায় 'বাণিজ্যতরী' বাঁধা পড়ে থাকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন:  'নোঙর' কবিতায় 'বাণিজ্যতরী' বাঁধা পড়ে থাকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর

"চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ ।"-অষ্ট গজরাজের পরিচয় দাও ।

প্রশ্ন: "চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ ।" অষ্ট গজরাজের পরিচয় দাও