চিঠি — স্বামী বিবেকানন্দ

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 06/30/2021 - 21:48

চিঠি — স্বামী বিবেকানন্দ                                                                                                        আলমোড়া, ২৯ জুলাই, ১৮৯৭

কল্যাণীয়া মিস নোবল

স্টার্ডি -র একখানি চিঠি কাল পেয়েছি । তাতে জানলাম যে, তুমি ভারতে আসতে এবং সবকিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সংকল্প । কাল তার উত্তর দিয়েছি । কিন্তু মিস মুলারের কাছ থেকে তোমার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম, তাতে এ পত্রখানিও আবশ্যক হয়ে পড়েছে; মনে হচ্ছে, সরাসরি তোমাকে লেখা ভালো ।

তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে । ভারতের জন্য, বিশেষত ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর—একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন । তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা—সর্বোপরি তোমার ধমনিতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন ।

কিন্তু বিঘ্নও আছে বহু । এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কী ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পারো না । এদেশে এলে তুমি নিজেকে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নরনারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে । তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা; ভয়েই হোক বা ঘৃণাতেই হোক—তারা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের খুব ঘৃণা করে । পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গেরা তোমাকে খামখেয়ালি মনে করবে এবং প্রত্যেকটি গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবে ।

তা ছাড়া, জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান । এদেশের প্রায় সব জায়গার শীতই তোমাদের গ্রীষ্মের মতো; আর দক্ষিণাঞ্চলে তো সর্বদাই আগুনের হলকা চলছে ।

শহরের বাইরে কোথাও ইউরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই । এসব সত্তেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি । সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমনি আমি কেউ নই; তবু আমার যেটুকু প্রভাব আছে, সেটুকু দিয়ে আমি অবশ্যই তোমায় সাহায্য করব ।

কর্মে ঝাঁপ দেবার পূর্বে বিশেষভাবে চিন্তা করো এবং কাজের পরে যদি বিফল হও কিংবা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে— তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাকো । 'মরদ কি বাত হাতি কা দাঁত'—একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা । আবার তোমাকে একটু সাবধান করা দরকার— তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মিস মুলার কিংবা অন্য কারও পক্ষপুটে আশ্রয় নিলে চলবে না । তাঁর নিজের ভাবে মিস মুলার চমৎকার মহিলা ; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই । এই মনোভাব তাঁর অজ্ঞাতসারেই বারবার মাথা তুলছে এবং দিন কয়েকের মধ্যেই তুমি বুঝতে পারবে যে, তাঁর সঙ্গে বনিয়ে চলা অসম্ভব । তাঁর বর্তমান সংকল্প এই যে, তিনি কলকাতায় একটি বাড়ি ভাড়া নেবেন— তোমার ও নিজের জন্য এবং ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে যেসব বন্ধুদের আসার সম্ভাবনা আছে তাঁদেরও জন্য । এটা অবশ্য তাঁর সহৃদয়তা ও অমায়িকতার পরিচায়ক ; কিন্তু তাঁর মঠাধ্যক্ষাসুলভ সংকল্পটি দুটি কারণে কখনও সফল হবে না— তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততা । কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভালো ; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় ।

মিসেস সেভিয়ার নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভালো, এত স্নেহময়ী তিনি । সেভিয়ার দম্পতিই একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমনকি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না । একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি । কিন্তু তাঁদের এখনও কোনো নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই । তুমি এলে তোমার সহকর্মীররূপে তাঁদের পেতে পারো এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে । কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে ।

আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড ও বস্টনের মিসেস বুল এই শরৎকালেই ভারত পরিভ্রমণে আসছেন । মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লন্ডনেই দেখেছ— সেই পারি-ফ্যাসনের পোশাক-পরিহিতা মহিলাটি ! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন । তাঁরা ইউরোপ হয়ে এদেশে আসছেন, সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে ।

মি. স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি । কিন্তু চিঠিটা বড়ো শুষ্ক এবং প্রাণহীন । লন্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয় ।

অনন্ত ভালোবাসা জানবে ।  ইতি                  সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত, বিবেকানন্দ

(সম্পাদিত)

————————————————————————————————

উল্লেখপঞ্জি

১. মিস নোবল : সম্পূর্ণ নাম মিস মার্গারেট ই নোবল । স্বামীজির শিষ্যাদের মধ্যে অন্যতম এবং অগ্রগণ্য । স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায় এদেশে আসেন এবং ভারতের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন । (পাঠ্য চিঠিতে সেই প্রেক্ষাপটটিই উল্লিখিত হয়েছে ।) ভারতে স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের কাজে এবং স্বাধীনতার আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন । ভারতীয় আদর্শে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলনের জন্য কলকাতার বাগবাজারে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যা আজকে 'নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়' নামে খ্যাত । তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো—'The Master as I saw him', 'Web of Indian Life' প্রভৃতি । তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দার্জিলিং -এ দেহত্যাগ করেন ।

২. স্টার্ডি : মি. ই. টি স্টার্ডি । স্বামী বিবেকানন্দের একজন ইংরেজ ভক্ত । প্রথম জীবনে যখন ভারতে ছিলেন তখন আলমোড়ায় তপস্যা করেন । ইংল্যান্ডে বেদান্ত প্রচারের কাজে তিনি স্বামীজিকে সাহায্য করেন ।

৩. মিস মুলার : সম্পূর্ণ নাম মিস হেনরিয়েটা মুলার । ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে স্বামীজি কিছুদিন তাঁর অতিথি ছিলেন । বেলুড় মঠ স্থাপনের কাজে তিনি অর্থসাহায্য করেছিলেন ।

৪. মিসেস সেভিয়ার : ক্যাপ্টেন জে এইচ সেভিয়ারের স্ত্রী । স্বামী বিবেকানন্দের বিখ্যাত ইংরেজ শিষ্যা । বেদান্ত প্রচারের কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন । স্বামীজির ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায় 'মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি বহু বছর মায়াবতী এবং শ্যামলাতালে বাস করেন । রামকৃষ্ণ সংঘে 'মাদার' নামে পরিচিত ছিলেন । ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে মিসেস সেভিয়ারের মৃত্যু হয় ।

৫. সেভিয়ার দম্পতি : ক্যাপ্টেন জে. এইচ. সেভিয়ার এবং তাঁর স্ত্রী মিসেস সেভিয়ারের কথা বলা হয়েছে । মিসেস সেভিয়ারের প্রসঙ্গে আমরা আগেই জেনেছি । স্বামীজির ইচ্ছায় বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যে সেভিয়ার দম্পতি 'মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মায়াবতীতে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মৃত্যু হয় ।

৬. মিস ম্যাকলাউড : সম্পূর্ণ নাম মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউড । স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্য দেশীয় প্রধান অনুরাগী ভক্তদের মধ্যে অন্যতমা । তিনি সবসময় স্বামীজিকে তাঁর কাজে সাহায্য করতেন । তাঁর জীবন স্বামীজির চিন্তা-ভাবনা ও কাজের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিল । স্বামীজি তাঁকে 'জো' বলে ডাকতেন । তিনি বহুবার বেলুড় মঠে এসেছেন । ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার হলিউড শহরে তাঁর মৃত্যু হয় ।

৭. মিসেস বুল : সম্পূর্ণ নাম সারা (Sarah) বুল । নরওয়েবাসী বিখ্যাত বেহালা বাদক মি: ওলি বুলের স্ত্রী । স্বামীজির শিষ্যা । অনেক চিঠিতে স্বামীজি তাঁকে 'মা' বা 'ধীরমাতা' বলে সম্বোধন করেছেন । তিনি বেলুড় মঠ স্থাপনের কাজে স্বামীজিকে অনেক অর্থসাহায্য করেছিলেন । এছাড়া অন্যান্যভাবেও তিনি এদেশে ও পাশ্চাত্যে স্বামীজিকে সাহায্য করেছিলেন ।

*********************************

 

Comments

Related Items

'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে দুই রক্ষীর কথাবার্তায় সমাজের কোন ছবি ফুটে উঠেছে তা লেখ ।

প্রশ্ন : 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে দুই রক্ষীর কথাবার্তায় সমাজের কোন ছবি ফুটে উঠেছে তা লেখ

'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে রাজশ্যালকের ভূমিকা নির্দেশ কর ।

প্রশ্ন : 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশে রাজশ্যালকের ভূমিকা নির্দেশ কর ।

উঃ মহাকবি কালিদাসের লেখা 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম' নাটকের ষষ্ঠ অঙ্ক থেকে 'ধীবর-বৃত্তান্ত' নাট্যাংশটি নেওয়া হয়েছে । বাংলায় এটির তরজমা করেছেন সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী ।

'নোঙর' কীসের প্রতীক তা বুঝিয়ে দাও ।

প্রশ্ন: 'নোঙর' কীসের প্রতীক তা বুঝিয়ে দাও

'নোঙর' কবিতায় 'বাণিজ্যতরী' বাঁধা পড়ে থাকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন:  'নোঙর' কবিতায় 'বাণিজ্যতরী' বাঁধা পড়ে থাকার তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর

"চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ ।"-অষ্ট গজরাজের পরিচয় দাও ।

প্রশ্ন: "চারি মেঘে জল দেয় অষ্ট গজরাজ ।" অষ্ট গজরাজের পরিচয় দাও