চন্দ্রনাথ — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

Submitted by avimanyu pramanik on Wed, 06/30/2021 - 21:57

চন্দ্রনাথ — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

সারকুলার রোডের সমাধিক্ষেত্র হইতে বাহির হইয়া চন্দ্রনাথের কথাই ভাবিতে ভাবিতে বাড়ি ফিরলাম । কত কথা মনে হইতেছে ! দীর্ঘ এত দিনের জীবন-ইতিহাসের মধ্যে কয়টি পৃষ্ঠায় চন্দ্রনাথ গভীর রাত্রির মধ্যগগনচারী কালপুরুষ নক্ষত্রের মতো দীপ্তিতে পরিধিতে, প্রদীপ্ত ও প্রধান হইয়া আছে । কালপুরুষ নক্ষত্রের সঙ্গে চন্দ্রনাথের তুলনা করিয়া আমার আনন্দ হয় । ওই নক্ষত্রটির খড়্গধারী ভীমকায় আকৃতির সঙ্গে চন্দ্রনাথের আকৃতির যেন একটা সাদৃশ্য আছে । এমনই দৃপ্ত ভঙ্গিতে সেও আপনার জীবনের কক্ষপথে চলিয়াছে, একদিন পিছনে ফিরিয়া চাহিল না, ক্ষণিক বিশ্রাম করিল না, যাহাকে কুক্ষিগত করিবার অভিপ্রায়ে তাহার এ উন্মত্ত যাত্রা তাহাকে আজও পাইল না, তবু সে চলিয়াছে । 

সঙ্গে সঙ্গে আরও একজনকে মনে পড়িতেছে— হীরুকে ।

চন্দ্রনাথ, হীরু, আমি সহপাঠী । আরও একজনকে মনে পড়িতেছে—চন্দ্রনাথের দাদা নিশানাথবাবুকে । কেমন করিয়া যে এই তিনজন একই সময়ে ক্ষুদ্র একটি গ্রামের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিলাম বলিতে পারি না, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করিব না । আগ্নেয়গিরি গর্ভের মধ্যে কল্পনাতীত বিচিত্র সমাবেশে যত কিছু প্রলয়ংকর দাহ্য বস্তু সমাবিষ্ট হয় কী করিয়া । এও হয়তো সেই বিচিত্র সমাবেশ ।

ঘরে কেহ নাই । টেবিলের উপর টেবিল-ল্যাম্পটা অকম্পিত প্রদীপ্ত জ্যোতিতে জ্বলিতেছে । আলোকিত কক্ষের মধ্যে একা বসিয়া চন্দ্রনাথ, হীরু ও নিশানাথকে ভাবিতেছি । সম্মুখেই দেওয়ালে বিলম্বিত বড়ো আয়নাটির মধ্যে আমারই প্রতিবিম্ব আমার দিকে চিন্তাকুল নেত্রে চাহিয়া বসিয়া আছে । অলীক কায়াময় ছায়া, তবু সে আমার এই স্মৃতি স্মরণে বাধা দিয়া তাহারই দিকে আমাকে আকর্ষণ করিতেছে । আলোটা নিভাইয়া দিলাম । মুহূর্তে ঘরখানা প্রগাঢ় অন্ধকারে ভরিয়া উঠিল ।

অতীতের রূপ এই অন্ধকার । আলোকিত যে দিবসটি অবসান হইয়া তমসা-পারাবারের মধ্যে ডুব দিল, আর সে তো আলোকিত প্রত্যক্ষের মধ্যে ফেরে না । তাই অন্ধকারের মধ্যে তাহাকে খুঁজিতেছি । সে দেখা দিল । অন্ধকারের মধ্যে সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল কিশোর চন্দ্রনাথ । দীর্ঘাকৃতি সবল সুস্থ দেহ নির্ভীক দৃষ্টি কিশোর । অসাধারণ তাহার মুখাকৃতি; প্রথমেই চোখে পড়ে চন্দ্রনাথের অদ্ভুত মোটা নাক; সামান্য মাত্র চাঞ্চল্যেই নাসিকাপ্রান্ত স্ফীত হইয়া ওঠে । বড়ো বড়ো চোখ, চওড়া কপাল, আর সেই কপালে ঠিক মধ্যস্থলে শিরায় রচিত এক ত্রিশূল-চিহ্ন । এই কিশোর বয়সেও চন্দ্রনাথের ললাটে শিরার চিহ্ন দেখা যায় । সামান্য উত্তেজনায় রক্তের চাপ ঈষৎ প্রবল হইলেই নাকের ঠিক উপরেই মধ্য-ললাটের ওই ত্রিশূল-চিহ্ন মোটা হইয়া ফুলিয়া ওঠে ।

সঙ্গে সঙ্গে হেডমাস্টারমহাশয়কে মনে পড়িতেছে । শীর্ণ দীর্ঘকায় শান্তপ্রকৃতির মানুষটি— ওই যে বোর্ডিং -এর ফটকের সম্মুখেই চেয়ার-বেঞ্চের আসন পাতিয়া বসিয়া আছেন । হুঁকাটি হাতে ধরাই আছে । চিন্তাকুল বিমর্ষ নেত্রে আমাকে বলিলেন— নরু, তুমি একবার জেনে এসো তো চন্দ্রনাথ কী বলে !

দুর্দান্ত চন্দ্রনাথের আঘাতে সমস্ত স্কুলটা চঞ্চল, বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে । প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের সময়; চন্দ্রনাথ প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করিয়া পত্র দিয়াছে । সেকেন্ড প্রাইজ সে গ্রহণ করিতে চায় না । সে আজ পর্যন্ত কখনও সেকেন্ড হয় নাই । তাঁহার কথা অবহেলা করিতে পারিলাম না ।

চন্দ্রনাথের কাছেই গেলাম । দারিদ্র-জীর্ণ স্বল্পালোকিত চন্দ্রনাথের ঘরখানার মধ্যে চন্দ্রনাথ বসিয়া আপন মনে কী লিখিতেছিল । তাহার কাছে গিয়া দাড়াইলাম । সে লিখিতেই থাকিল, কোনো অভ্যর্থনা করিল না; সে তাহার স্বভাব নয় । আমি নিজেই বসিয়া প্রশ্ন করিলাম, কী লিখছিস ?

লিখিতে-লিখিতেই চন্দ্রনাথ উত্তর দিল, ইউনিভার্সিটি এগজামিনের রেজাল্ট তৈরি করছি । কে কত নম্বর পাবে তাই দেখছি ।

তাহার কথা শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম । চন্দ্রনাথ আরও খানিকটা লিখিয়া কাগজখানা আমার সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া বলিল, দেখ ।

কাগজটায় চোখ বুলাইতেছিলাম । চন্দ্রনাথ বলিতেছিল, আমার যদি সাড়ে-পাঁচশো কী তার বেশি ওঠে, তবে স্কুলের এই রেজাল্ট হবে—মানে দুটো ফেল, অমিয় আর শ্যামা; তা ছাড়া সব পাশ হবে । আর আমার যদি পাঁচশো-পঁচিশের নীচে হয়, তবে দশটা ফেল; তুই তাহলে থার্ড ডিভিশনে যাবি ।

বেশ মনে পড়িতেছে, তাহার কথা শুনিয়া রাগ হইয়াছিল । এই দাম্ভিকটা যেন ফেল হয়—এ কামনাও বোধ হয় করিয়াছিলাম ।

চন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, তুই বোধ হয় রাগ করছিস ? কিন্তু অনুপাতের আঙ্কিক নিয়মে যার মূল্য যতবার কষে দেখবে, একই হবে । একের মূল্য কমে, সকলের কমবে । দিস ইজ ম্যাথমেটিকস ।

আমি এইবার কথাটা পাড়িব ভাবিতেছিলাম, কিন্তু সে হইল না । চন্দ্রনাথের দাদা একখানা পত্র হাতে আসিয়া দাঁড়াইলেন, চন্দ্রনাথের হাতে পত্রখানা দিয়া বলিলেন, এ কী ! পত্রখানার উপর দৃষ্টি বুলাইয়া চন্দ্রনাথ অসংকোচে বলিল, আমি সেকেন্ড প্রাইজ রিফিউজ করেছি ।

কারণ ?

কারণ ? চন্দ্রনাথের নাসিকাপ্রান্ত স্ফীত হইয়া উঠিল, ললাটে শিরায় রচিত ত্রিশূল-চিহ্ন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করিতেছিল । এক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয় সে বলিল— কারণ, সেকেন্ড প্রাইজ নেওয়া আমি বিনিথ মাই ডিগনিটি বলে মনে করি ।

চন্দ্রনাথের দাদা ক্ষোভে যেন কাঁপিতেছিলেন, বহুকষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া তিনি বলিলেন, কথাটা বলতে তোমার লজ্জায় বাধল না ? ডিগনিটি ! একে তুমি ডিগনিটি বল ? তোমার অক্ষমতার অপরাধ !

বাধা দিয়া চন্দ্রনাথ বলিল, তুমি জান না দাদা ।

কী জানি না ? জানবার এতে আছে কী ?

স্কুলের সেক্রেটারির ভাইপো ফার্স্ট হয়েছে, সে আমারই সাহায্যে হয়েছে । আর ওর যে প্রাইভেট মাস্টার— স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার— তিনি, কী বলব, প্রশ্নপত্র ছাত্রটির কাছে গোপন রাখেননি । তারও ওপর উত্তর বিচারের সময় ইচ্ছাকৃত ভুলও করেছেন তিনি এবং আরও দু-একজন ।

চন্দ্রনাথের দাদার মুখ দিয়া কথা সরিতেছিল না । ভদ্রলোক নির্বিরোধী শান্তপ্রকৃতির মানুষ । তিনি অবাক হইয়া চন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন । চন্দ্রনাথ বলিল, অঙ্কের পরীক্ষার দিন সে আমায় মিনতি করলে, আমি তাকে তিনটে অঙ্ক আমার খাতা থেকে টুকতে দিলাম । মাস্টার পূর্বে বলে দেওয়া সত্ত্বেও সে সময় তার মনে ছিল না ।

চন্দ্রনাথের দাদা গম্ভীর এবং ধীর কণ্ঠস্বরে বলিলেন, তোমার সঙ্গে তর্ক করে ফল নেই । তুমি ওই পত্র প্রত্যাখ্যান করে ক্ষমা চেয়ে হেডমাস্টার মহাশয়কে পত্র লেখো, বুঝলে ?

চন্দ্রনাথ বলিল, না ।

কঠোরতর স্বরে চন্দ্রনাথের দাদা বলিলেন, তোমায় করতে হবে ।

না ।

না ? চন্দ্রনাথের দাদা যেন বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেলেন এবার ।

না ।

করবে না ?—ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর এবার কাঁপিতেছিল ।

না ।

কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া চন্দ্রনাথের দাদা বলিলেন, তোমার বউদি বলত, আমি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু তুমি এতদূর স্বাধীন হয়েছ ? ভালো, আজ থেকে তোমার সঙ্গে আমার আর কোনো সংস্রব রইল না । আজ থেকে আমরা পৃথক ।

অবিচলিত কণ্ঠস্বরে চন্দ্রনাথ বলিল, বেশ ।

চন্দ্রনাথের দাদা নতশিরে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন । তিনি নিশ্চয়ই এ উত্তর প্রত্যাশা করেন নাই, বিশেষ এমন সংযত নিরুচ্ছ্বসিত কন্ঠের উত্তর । আমি বেশ বুঝিলাম, ভদ্রলোক আত্মসংবরণের জন্য বিপুল প্রয়াস করিতেছেন । দাঁতে ঠোঁট কামড়াইয়া তিনি দাঁড়াইয়া ছিলেন, চোখের দৃষ্টিতে বেদনা ও ক্রোধের সে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ । এমন বুকে দাগ কাটা দৃষ্টি আমার জীবনে আমি খুব কমই দেখিয়াছি । এক মুহুর্তেও যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি । দাদা মুখ তুলিয়া সম্মুখের জানালার ভিতর দিয়া আখড়ার তমালগাছটার দিকে চাহিলেন । কাকের কোলাহল চলিয়াছে সেখানে, তাঁহাকে দেখিয়া আমার বড়ো কষ্ট হইল । আজও এই অন্ধকারের মধ্যে আমি চোখ মুদিলাম ।

বোর্ডিং-এ আসিয়া মাস্টারমহাশয়কে সংবাদটা দিতে গিয়া দেখিলাম, তিনি তখনও সেই তেমনিই একা চিন্তাকুল নেত্রে বসিয়া আছেন । আমাকে দেখিবামাত্র বলিলেন, কী হলো নরু, সে কী বললে ?

তাঁহাকে অকপটেই সমস্ত বলিলাম । তিনি হুঁকাটি হাতে ধরিয়াই নীরবে বসিয়া রহিলেন ।

মাস্টারমহাশয় তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, আমি একবার যাব নরেশ ? কী বলো তুমি ? চন্দ্রনাথের কাছে / না না, পৃথক হবে কেন ? নাঃ ছি !

আমি বলিলাম, না স্যার, আপনি যাবেন না । যদি কথা না শোনে ?

শুনবে না, আমার কথা শুনবে না ? মাস্টারমহাশয়ের কণ্ঠস্বর উত্তেজিত হইয়া উঠিল । আমি উত্তর দিলাম না, নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলাম ।

কিছুক্ষণ পরে মাস্টারমহাশয় বলিলেন, আমারই অন্যায় হলো । চন্দ্রনাথের দাদাকে না জানালেই হতো । না, ছি ছি ছি !

আমি চলিয়া আসিতেছিলাম, তিনি আবার ডাকলেন, তুমি বলছো নরেশ, আমার যাওয়া ঠিক হবে না, চন্দ্রনাথ আমার কথা শুনবে না ?

আমি নীরবেই কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলাম, তারপর ধীরে ধীরে চলিয়া আসিলাম ।

দিন দুই পর শুনিলাম চন্দ্রনাথ সত্যিই দাদার সহিত পৃথক হইয়াছে । চন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিলাম, সে বলিল, পৃথক মানে কী ? সম্পত্তি তো কিছুই ছিল না, মাত্র বাড়িখানা আর বিঘে কয় জমি, কিছু বাসন । সে ভাগ হয়ে গেল । আমাকে তো এইবার নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হতো, এ ভালোই হলো ।

আমি চুপ করিয়া রহিলাম । বোধ হয় সেদিন সে সময়ে ভাবিয়াছিলাম, চন্দ্রনাথের সহিত সংস্রব রাখিব না । মনে মনে সংকল্পটা দৃঢ় করিতেছিলাম ।

চন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, হীরু এসেছিল আজ আমার কাছে । বলে, কাকা বলছেন তোমাকে তিনি একটা স্পেশাল প্রাইজ দেবেন ।

হীরুই সেবার ফার্স্ট হইয়াছিল— আমাদের স্কুলের সেক্রেটারির ভাইপো ।

আমি প্রশ্ন করিলাম, কী বললি তুই ?

চন্দ্রনাথ বলিল, তার কাকাকে ধন্যবাদ দিয়ে পাঠালাম, আর বলে দিলাম, একান্ত দুঃখিত আমি, সেই গ্রহণ করতে আমি পারি না । এই প্রস্তাবই আমার পক্ষে অপমানজনক ।

চন্দ্রনাথের মুখের দিকেই চাহিয়া ছিলাম । সে আবার বলিল, হেডমাস্টারমশায়ও ডেকে পাঠিয়েছিলেন । তাঁকেও উত্তর দিয়ে দিলাম, গুরুদক্ষিণার যুগ আর নেই । স্কুলের সঙ্গে দেনা-পাওনা আমার মিটে আছে, দু-তিন মাসের মাইনে বাড়তি দিয়ে এসেছি আমি । সুতরাং যাওয়ার প্রয়োজন নেই আমার ।

সেই মুহূর্তে উঠে আসিলাম ।

দুই

ইহার পরই আমি চলিয়া গেলাম মামার বাড়ি । পরীক্ষার খবর বাহির হইলে হীরুর পত্র পাইয়া কিন্তু অবাক হইয়া গেলাম, চন্দ্রনাথের অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়া গিয়াছে । হীরু কলিকাতা হইতে দীর্ঘ পত্রে সমস্ত ফলাফল জানাইয়াছে । দেখিলাম, দশটি ছেলে ফেল হইয়াছে, আমি তৃতীয় বিভাগেই কোনোরূপে পাশ হইয়া গিয়াছি, চন্দ্রনাথও পাঁচশো-পঁচিশ পায় নাই । কিন্তু একটি শুধু মেলে নাই— হীরু চন্দ্রনাথকে পিছনে ফেলিয়া গিয়াছে । হীরু লিখিয়াছে, সে স্কলারশিপ পাইবে । মনে মনে দুঃখিত না হইয়া পারিলাম না, সত্য বলিতে কী, চন্দ্রনাথ ও হীরুতে অনেক প্রভেদ ! চন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্বে আমার অন্তত সন্দেহ ছিল না । অপরাহ্ণে পাঁচটার ট্রেনে মামার বাড়ি হইতে ফিরিয়াই সঙ্গে সঙ্গে হীরুর বাড়িতে প্রীতিভোজনের নিমন্ত্রণ পাইলাম । হীরু স্কলারশিপ পাইবে, তাহারই প্রীতিভোজ ।

আমি কিন্তু প্রথমেই গেলাম চন্দ্রনাথের বাড়ি । নির্জন বাড়িখানা খাঁ খাঁ করিতেছিল । কেহ কোথাও নাই, শয়নঘরখানারও দুয়ার বন্ধ, কড়ায় একটা অতি সামান্য দামের তালা ঝুলিতেছে ।

সন্ধ্যায় হীরুর বাড়ি গেলাম । উৎসবের বিপুল সমারোহ সেখানে । হীরু ধনীর সন্তান, অর্থের অভাব নাই; চিনা লন্ঠন ও রঙিন কাগজের মালার নিপুণ বিন্যাসে তাহাদের বাড়ির পাশের আমবাগানটার সে শোভা আজও আমার মনে আছে । হীরুর কাকা শৌখিন ধনীসন্তান বলিয়া জেলার মধ্যে খ্যাতি ছিল, তিনি নিজে সেদিন বাগানটাকে সাজাইয়াছিলেন । বিশিষ্ট অতিথিও অনেক ছিলেন, জনদুয়েক ডেপুটি, ডি.এস.পি.,স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রার, থানার দারোগা, তাহা ছাড়া গ্রামস্থ ব্রাহ্মণ কায়স্থ ভদ্রলোকজন সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিলেন ।

হীরুকে স্পষ্ট মনে পড়িতেছে, লাবণ্যময় দেহ, আয়ত কোমল চোখে মোহময় দৃষ্টি । হীরুর কথা মনে করিয়া আকাশের দিকে চাইলে, মনে পড়ে শুকতারা । অমনিই প্রদীপ্ত, কিন্তু সে দীপ্তি কোমল স্নিগ্ধ ।

হীরু পরম সমাদর করিয়া আমাকে বসাইল । নানা কথার মধ্যে সে বলিল, কাকা বলছিলেন, এখন থেকে আই সি. এস. -এর জন্যে তৈরি হও । বিলেতে যেতে হবে আমাকে । বিলেতে যাবার আমার বড়ো সাধ, নরু ।

আমার কিন্তু বারবার মনে পড়তেছিল চন্দ্রনাথকে । কিন্তু সেদিন সেখানে তাহার কথা আমি তুলিতে পারি নাই । হীরুই বলিল, আজই দুপুরে সে চলে গেল । আমি তার আগেই তাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম, তবুও সে চলে গেল ! একটা দিন থেকে গেলে কী হতো ?

হীরু বলিল, মাস্টারমশায়—মাস্টারমশায় ।

সচেতন হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিলাম, শীর্ণকায় দীর্ঘাকার মানুষটি এন্ডির চাদরখানি গায়ে দিয়া আমাদের দিকেই আসিতেছেন । আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম ।

হাসিয়া মাস্টারমহাশয় বলিলেন, আজই এলে নরেশ ?

মাস্টারমহাশয়ের ওইটুকু এক বিশেষত্ব, ছাত্র তাঁহার অধিকারের গন্ডি পার হইলেই সে আর 'তুই' নয়, তখন সে 'তুমি' হইয়া যায় তাঁহার কাছে ।

তিনি আবার বলিলেন, তুমি পড়বে নিশ্চয় নরেশ । কিন্তু সাহিত্যচর্চাটা পড়ার সময় একটু কম করো বাবা । তবে ছেড়ো না, ও একটা বড়ো জিনিস । জেনো, Shame in crowd but solitary pride হওয়াই উচিত ও বস্তু ।

আমি চুপ করিয়া থাকিলাম । হীরু বলিল, নরুর লেখা যে কাগজে বেরিয়েছে এবার স্যার ।

 হ্যাঁ ? বেশ, বেশ । আমাকে লেখাটা দেখাবে তো নরেশ, পড়ব আমি ।

তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, চন্দ্রনাথ কোথায় গেল, কাউকে বলে গেল না ? তোমাকেও কি কিছু জানিয়ে যায়নি— পত্র-টত্র লিখে ?

বলিলাম, না স্যার, কাউকেই সে কিছু জানিয়ে যায়নি ।

লাঠির উপর ভর দিয়া মাস্টারমহাশয় কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন, কী যেন তিনি চিন্তা করিতেছিলেন । আমরাও নীরব ।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মাস্টারমহাশয় নীরবেই চলিয়া গেলেন, আমরা আবার বসিলাম ।

হীরু বলিল, চন্দ্রনাথ একখানা চিঠি দিয়ে গেছে । দেখবি ?

চিঠিখানা দেখিলাম, সে লিখিয়াছে—

প্রিয়বরেষু, (প্রিয়বরেষু কাটিয়া লিখিয়াছে) প্রীতিভাজনেষু,

আজি আমার যাত্রার দিন, সুতরাং থাকিবার উপায় নাই, আমাকে মার্জনা করিও । তোমার সফলতায় আনন্দ প্রকাশ করিতেছি । কিন্তু একটা কথা বারবার মনে হইতেছে, এ উৎসবটা না করলেই পারিতে । স্কলারশিপটা কী এমন বড়ো জিনিস ! ভালোবাসা জানিবে । ইতি—      চন্দ্রনাথ

চিঠিখানা হীরুকে ফিরাইয়া দিলাম । হীরু বলিল, চিঠিখানা রেখে দিলাম আমি । থাক, এইটেই আমার কাছে তার স্মৃতিচিহ্ন ।

সে আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা, কোথায় গেল সেই ? করবেই বা কী ?

সে যেন নিজেও এ কথা চিন্তা করিয়া দেখিতেছিল ।

উত্তর দিয়াছিলাম, জানি না ।

কিন্তু কল্পনা করিয়াছিলাম কিশোর চন্দ্রনাথ কাঁধে লাঠির প্রান্তে পোঁটলা বাঁধিয়া সেই রাত্রেই জনহীন পথে একা চলিয়াছে । দুই পাশে ধীর মন্থর গতিতে প্রান্তর যেন পিছনের দিকে চলিয়াছে, মাথার উপরে গভীর নীল আকাশে ছায়াপথ, পার্শ্বে কালপুরুষ নক্ষত্র সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে ।

(সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)

****

Comments

Related Items

কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কাব্যাংশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি কিভাবে ধরা পড়েছে তা লেখ ।

প্রশ্ন: কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি কাব্যাংশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি কিভাবে ধরা পড়েছে তা লেখ

'দাম' গল্পে সুকুমার কোন উপলব্ধিতে পৌঁছেছে তা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : 'দাম' গল্পে সুকুমার কোন উপলব্ধিতে পৌঁছেছে তা আলোচনা কর

ইলিয়াসের জীবনে কিভাবে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল ?

প্রশ্ন:-  ইলিয়াসের জীবনে কিভাবে বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল ?

"এটা খুব জ্ঞানের কথা'' । —কার কোন কথাকে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে ? এবং কেন ?

প্রশ্ন : "এটা খুব জ্ঞানের কথা'' । —কার কোন কথাকে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে ? এবং কেন ?

নব নব সৃষ্টি — সৈয়দ মুজতবা আলী

নব নব সৃষ্টি — সৈয়দ মুজতবা আলী