প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা ও তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের ধর্মাবলী

Submitted by arpita pramanik on Tue, 02/12/2013 - 17:51

প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা ও তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের ধর্মাবলী

প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা (Natural Radioactivity) : কতকগুলি ভারী মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফুর্তভাবে অবিরাম গতিতে ভেঙ্গে গিয়ে নতুন মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় এবং সেই সঙ্গে শক্তিশালী রশ্মির বিকিরণ ঘটায় । এই রশ্মির বিকিরণ অন্ধকারে ফটোগ্রাফিক প্লেটে বিক্রিয়া করে ও পাতলা ধাতব পাত ভেদ করতে পারে । তাপ, চাপ, আলোক, তড়িৎ চুম্বক বা রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রভৃতি বাহ্যিক কারণ কোনো কিছুই এই জাতীয় বিকিরণকে প্রভাবিত করতে পারে না । এটি একটি স্বতঃস্ফুর্ত ঘটনা ।

মৌলগুলি থেকে নিঃসৃত এই জাতীয় শক্তিশালী রশ্মিকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি (Radioactive rays) বলা হয় । বিভিন্ন মৌল দ্বারা তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিঃসরণের এই ঘটনাকে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা (Natural Radioactivity) বলা হয় । যেসব পদার্থ থেকে এই রশ্মি বিকিরিত হয় সেই পদার্থগুলিকে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ (Natural Radioactivity substance) বলা হয় । যেমন— ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি মৌল হল প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ । তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির নিউক্লিয়াসের ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাকে তেজস্ক্রিয় বিঘটন (Radioactive decay) বলা হয় ।

তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের ধর্মাবলী (Properties of Radioactive rays) :

তেজস্ক্রিয় রশ্মির মধ্যে তিন ধরনের বিকিরণ থাকে । এদেরকে আলফা রশ্মি (α -rays), বিটা রশ্মি (ß -rays) এবং গামা রশ্মি ( γ -rays) বলে । পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আলফা রশ্মি ধনাত্মক আধানযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার স্রোত— এদের আলফা কণা বলে । বিটা রশ্মি ঋণাত্মক আধানযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার স্রোত— এদের বিটা কণা বলে । গামা রশ্মি ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ

তেজস্ক্রিয় পদার্থের সক্রিয়তা : তেজস্ক্রিয় পদার্থের সক্রিয়তা বলতে বোঝায় প্রতি সেকেন্ডে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় পদার্থের যত সংখ্যক পরমাণুর বিঘটন হয় । তেজস্ক্রিয় পদার্থের সক্রিয়তা পরিমাপের এককগুলি হল— কুরি, রাদারফোর্ড, বেকারেল । 1 কুরি = 3.7 x 104 রাদারফোর্ড = 3.7 x 104 বেকারেল ।

আলফা রশ্মির ধর্ম :-

[i] আলফা কণার ভর একটি প্রোটনের ভরের 4 গুণ, অর্থাৎ 6.642 x 10-24 গ্রাম । কণাগুলি ধনাত্মক আধানযুক্ত, আধানের পরিমাণ 9.6 x 10-10 esu ।

[ii] α -কণা তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে প্রচন্ড বেগে নির্গত হয় । বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নিঃসৃত α -কণার বেগ বিভিন্ন হয় । এই বেগ 1.4 x 107 মি/সে থেকে 1.7 x 107 মি /সে পর্যন্ত হয় ।

[iii] α -কণা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ক্রিয়া করে ।  

[iv] ß -রশ্মি এবং [tex]\gamma [/tex] -রশ্মির তুলনায় α -রশ্মির ভেদন ক্ষমতা অনেক কম ।

[v] ধনাত্মক তড়িৎগ্রস্থ হওয়ায় α -কণার গতিপথ তড়িৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয় ।

[vi] এই কণার স্রোত জীবদেহের ক্ষতিসাধন করে ।

[vii] α -কণা আসলে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস (2He4) ।

[viii] আয়নন ক্ষমতা খুব বেশি । গামা রশ্মির তুলনায় আয়নন ক্ষমতা 10000 গুণ বেশি ।

বিটা রশ্মির ধর্ম :-

[i] ß -কণার ভর একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের [tex]\frac {1}{1836}[/tex] গুণ; অর্থাৎ 9.108 x 10-28 গ্রাম । কণাগুলি ঋণাত্মক আধানযুক্ত, আধানের পরিমাণ 4.8 x 10-10 esu. ।

[ii] তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে ß -কণা প্রচন্ড বেগে নির্গত হয় । এই গতিবেগের পরিমাণ আলোর গতিবেগের 0.3 থেকে 0.68 গুণ । 

[iii] ß -কণা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ক্রিয়া করে ।

[iv] α -কণার তুলনায় ß -কণার ভেদন ক্ষমতা প্রায় 100 গুণ বেশি ।

[v] ঋণাত্মক তড়িৎগ্রস্থ হওয়ায় ß -কণার গতিপথ তড়িৎক্ষেত্র ও চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয় ।

[vi] এই কণার স্রোত জীবদেহের ক্ষতিসাধন করে ।

[vii] ß -কণা আসলে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন (-1e°) ।

[viii] [tex]\gamma [/tex] রশ্মির তুলনায় আয়নন ক্ষমতা 100 গুণ বেশি ।

গামা রশ্মির ধর্ম :-

[i] খুব তীব্র তড়িৎ বা চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এই রশ্মির কোনো বিক্ষেপ সৃষ্টি করা যায় না । গামা রশ্মির প্রকৃতি এক্স-রশ্মির মতো এবং এই রশ্মি কোনো তড়িৎগ্রস্থ কণা দ্বারা গঠিত নয় ।

[ii] এই রশ্মির গতিবেগ আলোর গতিবেগের সমান— অর্থাৎ 3 x 108  m/s ।

[iii] ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর ক্রিয়া করে ।

[iv] গামা রশ্মির ভেদন ক্ষমতা খুব বেশি । α -রশ্মির তুলনায় এই রশ্মির ভেদনক্ষমতা 10000 গুণ বেশি ।

[v] জীবদেহের কোশ, কলা ইত্যাদির ওপর গামা রশ্মির ক্রিয়া অত্যন্ত মারাত্মক । ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই রশ্মি ব্যবহৃত হয় ।

[vi] [tex]\gamma [/tex] রশ্মি তির্যক তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ । তরঙ্গদৈর্ঘ্য 10-3 সেমি থেকে 10-11 সেমি ।

*****

Related Items

নিউক্লীয় বিভাজন (Nuclear fission)

যে নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় কোনো ভারী পরমাণু নিউক্লিয়াসকে উপযুক্ত শক্তিসম্পন্ন নিউট্রন কণা দ্বারা আঘাত করলে, ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসটি বিভাজিত হয়ে দুটি প্রায় সমভর বিশিষ্ট টুকরায় পরিণত হয় এবং সেই সঙ্গে কয়েকটি নিউট্রন এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়, সেই ঘটনাকে নিউক্লীয় ...

তেজস্ক্রিয় পদার্থের ব্যবহার, দুষণ ও সতর্কীকরণ

তেজস্ক্রিয়তা সম্পূর্ণরূপে একটি নিউক্লীয় ঘটনা । প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াসের ভাঙ্গনের ফলে যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সৃষ্টি হয় তাকে চিকিত্সাবিজ্ঞান, কৃষিকার্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে । রোগ নির্ণয় এবং রোগ ...

তেজস্ক্রিয়তার বৈশিষ্ট্য

বিভিন্ন গবেষণার পর তেজস্ক্রিয়তা সম্বন্ধে নীচের বিষয়গুলি জানা যায় । তেজস্ক্রিয়তা সম্পূর্ণরূপে একটি নিউক্লীয় ঘটনা [nuclear phenomenon] । এর সঙ্গে নিউক্লিয়াস বহির্ভূত ইলেকট্রনের কোনো সম্পর্ক নেই । যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা 83 -এর বেশি হয়, কেবলমাত্র তারাই ...

এক্স-রশ্মি ও সাধারণ আলোক-রশ্মির তুলনা

এক্স-রশ্মি এবং আলোক-রশ্মি উভয়েই তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ । শূন্য মাধ্যমে আলোক-রশ্মি এবং এক্স-রশ্মি উভয়ের বেগ (3 x 108 মিটার / সেকেন্ড) । উভয় রশ্মিই সরলরেখায় যায় । বিশেষ ব্যবস্থায় আলোক-রশ্মির মতো এক্স-রশ্মির প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ হয় । উভয় রশ্মিই ফটোগ্রাফিক ...

এক্স-রশ্মির ধর্ম ও এর ব্যবহার

এক্স-রশ্মি এক প্রকার তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হওয়ায় তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্রের দ্বারা এই রশ্মির গতিপথের কোনো বিচ্যুতি ঘটে না । এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম। এই রশ্মি মানুষের চোখে অনুভূতি জন্মায় না । কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রশ্মিকে কঠিন এক্স-রশ্মি ...