জীবজ অণু (Biomolecules)

Submitted by arpita pramanik on Wed, 04/17/2013 - 08:26

জীবজ অণু (Biomolecules) :

সজীব কোশে সংশ্লেষিত ক্ষুদ্র অণু (Micromolecules) ও বৃহদ অণুকে (Macromolecules) একত্রে জীবজ অণু বলা হয় । প্রায় সমস্ত জীবজ অণুই কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, নিউক্লীয়িক অ্যাসিড, লিপিড এই চারটি শ্রেণির কোনো একটির অন্তর্ভুক্ত । এগুলি কোশের জীবজ পলিমার (Biopolymer) । কার্বোহাইড্রেট সরল সুগারের (যেমন: গ্লুকোজ), প্রোটিন অ্যামিনো অ্যাসিডের, নিউক্লীয়িক অ্যাসিড মনোনিউক্লিওটাইডের এবং লিপিড ফ্যাটি অ্যাসিডের জীবজ পলিমার । কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং সালফার এই ছয়টি মৌলিক পদার্থ নিয়ে জীবজ অণুগুলি গঠিত ।

[i] দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধি : আমাদের খাদ্যের প্রধান উপাদান হল জৈব যৌগ । চাল, গম, আলু, ভুট্টা, প্রভৃতির মূল উপাদান হল শ্বেতসারজাতীয় পদার্থ । আখ থেকে প্রাপ্ত চিনি, মধু বা ফল থেকে চিনি জাতীয় পদার্থ বা কার্বোহাইড্রেট আমরা পেয়ে থাকি । এসব খাদ্য অন্ত্রের রস দ্বারা বিপাকীয় রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা গ্লুকোজে পরিণত হয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে যায় এবং দেহের পুষ্টি সাধন করে । কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে গঠিত যে জৈব যৌগে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অনুপাত সাধারণত 2 : 1 হিসাবে থাকে, তাকে কার্বোহাইড্রেট বলে । [ব্যতিক্রম রামনোজ (C6H12O5)] । এদের সাধারণ সংকেত Cn(H2O)n ; সবুজ উদ্ভিদ দেহে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় কার্বোহাইড্রেট তৈরি হয় । কার্বোহাইড্রেট প্রধানত তিন প্রকার : মনোস্যাকারাইড, অলিগোস্যাকারাইডপলিস্যাকারাইড । সর্বপ্রকার কার্বোহাইড্রেটের একককে মনোস্যাকারাইড বলে । যেমন- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, ও গ্যালাকটোজ । দুই থেকে দশটি মনোস্যাকারাইড নিয়ে গঠিত কার্বোহাইড্রেটকে অলিগোস্যাকারাইড বলে । যেমন- ডাইস্যাকারাইড (সুক্রোজ) । দশের বেশি মনোস্যাকারাইড পরস্পর যুক্ত হয়ে জল বিয়োজনের মাধ্যমে যে শর্করা গঠন করে, তাকে পলিস্যাকারাইড বলে । যেমন- স্টার্চ বা শ্বেতসার, গ্লাইকোজেন, সেলুলোজ ইত্যাদি । মনোস্যাকারাইড জীবদেহে শক্তি উৎপাদনে ও প্রাণীদেহে রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে । পলিস্যাকারাইড উদ্ভিদের কোশপ্রাচীর তৈরিতে সাহায্য করে ।         

[ii] দেহের গঠন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত কোশের পুনর্গঠনের জন্য আমিষজাতীয় খাদ্য :- যেমন— মাছ, মাংস, দুধ, নানাপ্রকার ডাল প্রভৃতির প্রয়োজন হয় । এই জাতীয় খাদ্যের প্রধান উপাদান হল প্রোটিন, প্রোটিন হল অ্যামাইনো অ্যাসিডের পলিমার ও কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত জটিল জৈব যৌগ । কখনও কখনও এতে সালফার ও ফসফরাস থাকে । প্রোটিন আর্দ্র-বিশ্লেষিত হয়ে অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিণত হয়—  যা দেহ গঠনে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত কোশের পুনর্গঠনে সাহায্য করে । অস্থি, পেশি, উৎসেচক, নখ, চুল, শিং ক্ষুর প্রভৃতি প্রোটিন দিয়ে তৈরি । 

[iii] সরষের তেল, বাদাম তেল, ঘি, মাখন— যা আমরা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করি, সেগুলি সবই স্নেহজাতীয় পদার্থ । এগুলি সবই জৈব পদার্থ  । এই জাতীয় খাদ্য দেহে তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন করে । 

[iv] ভিটামিন দেহের গঠন, সংরক্ষণ এবং ক্ষয়পূরণে অপরিহার্য । ভিটামিনও জৈব পদার্থ ছাড়া কিছু নয় ।

[v] চলন শক্তি :- প্রাণীদের চলাচল করার জন্য এবং দেহের পেশী সঞ্চালন করার জন্য যে শক্তি দরকার তা স্থিতি-শক্তি হিসাবে দেহের মধ্যে জমা থাকে । এই স্থিতিশক্তি জমা থাকে দেহের মধ্যে একটি জৈব যৌগের মধ্যে, যৌগটির নাম অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) । এই ATP থেকেই জোনাকি পোকার দেহে আলোর সৃষ্টি হয়, আর সমুদ্রে বৈদ্যুতিক মাছের দেহে তড়িৎশক্তির সৃষ্টি হয় । এছাড়াও বিভিন্ন যৌগ জীবন ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে । 

[vi] হিমোগ্লোবিন :- হিমোগ্লোবিন একটি প্রোটিন জাতীয় জৈব যৌগ যার প্রধান উপাদান লোহা । এই হিমোগ্লোবিন মেরুদন্ডী প্রাণীর দেহের প্রতিটি কোশে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় । 

[vii] এনজাইম :- জীবদেহের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া অবিরাম ঘটে চলেছে— এই বিক্রিয়াগুলি ঘটায় কতকগুলি জৈব অনুঘটক বা এনজাইম । এই এনজাইমগুলিও প্রোটিনজাতীয় জৈব যৌগ ।

[viii] বংশবৃদ্ধি এবং বংশের ধারা রক্ষা :- জিন নামে একরকম জৈব যৌগ, জীবের বংশ বৃদ্ধি ও বংশের ধারা রক্ষার জন্য দায়ী । এই জিন হল নিউক্লিক অ্যাসিড (nucleic acid) নামে একরকম জটিল জৈব যৌগ । নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজম ও রাইবোজোমে যে অ্যাসিড থাকে, তাকে নিউক্লিক অ্যাসিড বলে । নিউক্লিয়াসে নিউক্লিক অ্যাসিড প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিউক্লিওপ্রোটিন গঠন করে । নিউক্লিক অ্যাসিড দুই প্রকার— [ক] ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA) এবং [খ] রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (RNA) । নিউক্লিক অ্যাসিড হল ফসফরিক অ্যাসিড (H3PO4), একটি পাঁচ কার্বনযুক্ত শর্করা ও N2 যুক্ত ক্ষারমূলক নিয়ে গঠিত । নিউক্লিক অ্যাসিডের একককে নিউক্লিওটাইড বলে । ফসফরিক অ্যাসিড, 5-C যুক্ত শর্করা ও যেকোনো একটি ক্ষারমূলক একত্রিত হয়ে নিউক্লিওটাইড গঠন করে । অনেকগুলি নিউক্লিওটাইড পরপর শৃঙ্খলাকারে যুক্ত হয়ে নিউক্লিক অ্যাসিড অণু গঠন করে ।

ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA) :- DNA সজীব বস্তুর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য স্থায়ী রাসায়নিক অণু । এটি কোষের বা সামগ্রিকভাবে জীবের জনু থেকে জনুতে বংশগতির বার্তা বহন করে নিয়ে যায় । সকল প্রকার জৈবিক কাজের সঙ্গে DNA যুক্ত । 1953 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ওয়াটসন ও ক্রিক DNA -এর দ্বিতন্ত্রী মডেল (Double Helix) বর্ণনা করেন । DNA অণু দ্বিতন্ত্রী বিন্যাসযুক্ত । বহু নিউক্লিওটাইড যুক্ত একটি তন্তু অন্য তন্তুটির সঙ্গে সমান্তরালভাবে কিন্তু বিপরীত সজ্জাক্রমে অবস্থান করে । 

DNA -এর কাজ : [i] DNA জীবের বংশধারা এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে বহন করে,   [ii] DNA জিন গঠন করে, [iii] DNA বিভিন্ন প্রকার RNA ও প্রোটিন সংশ্লেষ করে [iv] প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোশের সকল কাজই নিয়ন্ত্রণ করে । 

রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (RNA) :- এটি প্রধানত একতন্ত্রী ও অসংখ্য রাইবোনিউক্লিওটাইডস দিয়ে গঠিত । এটি কোশের সাইটোপ্লাজমে মুক্ত অবস্থায় অথবা রাইবোজোমের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় থাকে । RNA দুই প্রকার: জেনেটিক ও নন-জেনেটিক । জেনেটিক RNA জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্য বহন করে এবং নন-জেনেটিক RNA প্রধানত প্রোটিন সংশ্লেষে সাহায্য করে ।

RNA -এর কাজ : [i] প্রোটিন সংশ্লেষে সাহায্য করে,  [ii] বংশগত বৈশিষ্ট্য বহন করে ।

[ix] হরমোন :- দেহের নানা গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয় । দেহের স্বাভাবিক ও সুষম বৃদ্ধির জন্য হরমোনের ক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ । ওই হরমোনগুলির সবই জৈব যৌগ ।  

[x] রোগ নিরাময়ে জৈব যৌগ :- প্রাণীর রোগ নিরাময়ের জন্য নানারকম জৈব যৌগকে ওষুধরূপে ব্যবহার করা হয় । যেমন— ম্যালেরিয়ায় কুইনাইন, টাইফয়েডে ক্লোরোমাইসিটিন, যক্ষ্মায় স্ট্রেপটোমাইসিন ইত্যাদি । ক্লোরোফর্ম, ইথার প্রভৃতি চেতনানাশক পদার্থ দেহে অস্ত্র চিকিৎসাকে যন্ত্রণা শূন্য করে । অতএব দেখা যায় যে, সব রকম জীবক্রিয়ায় জৈব যৌগের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ । পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য ল্যাবরেটরি হল জীবের শরীর । এই ল্যাবরেটরির কাজ যখন বন্ধ হয় যায় তখন জীবদেহে শক্তির সৃষ্টি এবং শক্তির রূপান্তর দুই-ই বন্ধ হয়ে যায়, ফলে নেমে আসে মৃত্যু ।

*****

Related Items

এক্স-রশ্মি উৎপাদনের নীতি

তীব্র গতিবেগ সম্পন্ন ইলেকট্রনের গতি উচ্চ গলনাঙ্ক বিশিষ্ট কোনো কঠিন বস্তু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হটাৎ কমে গেলে বা থেমে গেলে, এর গতিশক্তির কিছু অংশ তাপশক্তিতে রুপান্তরিত হয় । এই শক্তিশালী অদৃশ্য তরঙ্গকে এক্স-রশ্মি বলা হয় । 1895 খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী রন্টজেন ...

দুই তড়িদ্দ্বারবিশিষ্ট তাপীয় আয়ন ভালভ

দুই তড়িদ্দ্বারবিশিষ্ট তাপীয় আয়ন ভালভ বা ডায়োড ভালভ : বিভিন্ন ধরনের তাপীয় আয়ন ভালভ তৈরির কাজে তাপীয় আয়ন নিঃসরণকে ব্যবহার করা হয় । 1904 খ্রিস্টাব্দে স্যার ফ্লেমিং সর্বপ্রথম দুই তড়িদ্দ্বারবিশিষ্ট তাপীয় আয়ন ভালভ উদ্ভাবন করেন । প্রথমে এই ভালভকে ‘ফ্লেমিং ভালভ’ ...

তপ্ত ক্যাথোড-রশ্মি নল

এটি প্রধানত একটি বায়ুশূন্য কাচের নল । নলটির ভিতরের দেওয়ালে পরিবাহী পদার্থের আস্তরণ লাগানো থাকে । ক্যাথোড C হল ইলেকট্রনের উত্স । যখন তড়িৎপ্রবাহ পাঠিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একে উত্তপ্ত করা হয় তখন এ থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় । G হল গ্রিড, এটি নিকেলের ...

তাপীয় আয়ন নিঃসরণ

তাপীয় আয়ন নিঃসরণ: বিজ্ঞানী ড্রুড -এর মুক্ত ইলেকট্রন তত্ত্ব অনুযায়ী ধাতুর মধ্যে মুক্ত ইলেকট্রনগুলি স্বাধীনভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় । সাধারণভাবে এই ইলেকট্রনগুলি ধাতবপৃষ্ঠ ত্যাগ করে যেতে পারে না । কারণ ধাতবপৃষ্ঠ ওই ইলেকট্রনগুলির উপর একটি আকর্ষণ বল ...

গাণিতিক উদাহরণ : প্রবাহী তড়িৎবিজ্ঞান

প্রবাহী তড়িৎবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন গাণিতিক প্রশ্নের উত্তর ও আলোচনা, বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষায় আগত প্রশ্নপত্র এবং বিভিন্ন কম্পিটিটিভ এক্সাম এ আগত প্রশ্নের গাণিতিক উদাহরণ আলোচনা করা হলো ।