শব্দদূষণ (Sound Poullution)
জলদুষণ, বায়ুদূষণের মত শব্দদূষণও আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে । মূলত শব্দের প্রাবল্য তথা তীব্রতার কারণে শব্দ দূষণ ঘটে । শব্দের প্রাবল্য যত বেশি হয় মানুষের কানের পক্ষে তা তত বেশি পীড়াদায়ক হয় । শব্দের তীব্রতার মাত্রা পরিমাপ করা হয় ‘বেল’ এককে । ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এককটি বড়ো হওয়ায় তার 1/10 অংশ অর্থাৎ, ‘ডেসিবেল’ (dB) একক ব্যবহার করা হয় । নূন্যতম যে তীব্রতার শব্দ আমরা শুনতে পাই তাকে শূন্য ডেসিবেল (0dB) ধরলে 65dB তীব্রতা পর্যন্ত শব্দ আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের পক্ষে নিরাপদ । এর বেশি তীব্রতার শব্দ আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের পক্ষে ক্ষতি করে । এছাড়া বেশি তীব্রতার শব্দ পরোক্ষভাবে আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন ঘটায় ।
শব্দদূষণের কারণ :
বিভিন্ন উচ্চ তীব্রতার শব্দ পরিবেশে দূষণ ঘটায় । মাইকের জোরালো আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ, ইলেকট্রিক হর্ণের শব্দ, বিস্ফোরণ বা বাজি পটকার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, এয়ারপোর্টে এরোপ্লেনের ওঠা-নামার শব্দ ইত্যাদি আমাদের পরিবেশে সব সময়ই কানের পক্ষে পীড়াদায়ক শব্দ উৎপন্ন করে চলেছে । তাছাড়া বাড়িতে ব্যবহৃত পাম্প, জেনারেটর, উচ্চগ্রামে চালানো টিভি, রেডিও, সাউন্ড বক্স ইত্যাদির শব্দও শব্দদূষণ ঘটায় । বাজারের কোলাহল, খেলার মাঠের চিৎকার এগুলিও শব্দদূষণের কারণ ।
শব্দদূষণের ক্ষতিকারক প্রভাব :
শব্দদূষণের ক্ষতিকারক মাত্রা শব্দের তীব্রতা এবং স্থায়িত্বের কালের ওপর নির্ভর করে । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নির্দেশিত শব্দের নিরাপদ তীব্রতা লেভেল হল 65 ডেসিবেল (dB) । শব্দের তীব্রতা 65 dB (ডেসিবেল) এর বেশি হলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর । 80dB (ডেসিবেল) এর শব্দ আমাদের ক্রুদ্ধ করে তোলে, 85dB (ডেসিবেল) এর শব্দ কানের ক্ষতি করে, 110dB এর শব্দ খুবই অস্বস্তিকর এবং 150-160 dB এর আওয়াজ আমাদের চিরদিনের জন্য বধির করে দিতে পারে । অতিরিক্ত প্রাবল্যের শব্দ আমাদের বিরক্তি উৎপাদন করে, মনের একাগ্রতা নষ্ট করে এবং বিষন্নতা সৃষ্টি করে । শব্দদূষণের ফলে মানসিক উদ্বেগ, শ্বাসকষ্ট, পেপটিক আলসার ইত্যাদি হতে পারে । শব্দদূষণের ফলে আমরা স্নায়বিক রোগে ও মাথাধরায় আক্রান্ত হই । এর ফলে আমাদের কর্মদক্ষতা কমে, রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার (Glucose) মাত্রা বাড়ে । উচ্চ তীব্রতার শব্দ হৃদ রোগীদের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে । প্রসুতি নারী দীর্ঘকাল শব্দদূষণের মধ্যে থাকলে বিকলাঙ্গ, কম ওজনের এবং জড়বুদ্ধি সম্পন্ন সন্তান প্রসব করতে পারেন ।
শব্দদূষণের প্রতিকার :
শব্দদূষণ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব । সরকারি আইন অনুযায়ী প্রকাশ্য স্থানে উৎপন্ন শব্দের তীব্রতার ঊর্ধ্বসীমা 65 dB বেঁধে দেওয়া হয়েছে | এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের শব্দ দূষণের প্রতিকার করতে হবে । যেমন –
(i) কানের সমস্যা উত্তরণের জন্য যাঁরা কলকারখানা, বিমানবন্দর ইত্যাদি জায়গায় কাজ করেন তারা কানে ইয়ারপ্লাগ, নয়েজ হেলমেট ব্যবহার করতে পারেন ।
(ii) জলের পাম্প জেনারেটর ইত্যাদিকে সুনির্বাচিত স্থানে শব্দশোষক (Sound absorber) পদার্থ নির্মিত ভারী প্যাডের ওপর বসিয়ে শব্দদূষণ কমানো সম্ভব ।
(iii) রাস্তায় মোটরগাড়ির হর্ন আস্তে বাজিয়ে, শব্দের পরিকল্পনামাফিক শব্দশোষক পদার্থ নির্মিত বোর্ড প্রাচীর স্থাপন এবং বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত শব্দশোষক পদার্থের হোডিং ব্যবহার করে শব্দের তীব্রতা কমানো যায় ।
(iv) হাসপাতাল, স্কুল- কলেজের চারদিকে গাছপালার সারি তৈরি করে, করিডোরে কাঠ (শব্দশোষক) নির্মিত আসবাবপত্র রেখে শব্দের প্রাবল্য অনেকাংশে কমানো সম্ভব ।
(v) উপযুক্ত নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্প এলাকা, বিমানবন্দরগুলি থেকে জনবসতিকে দূরে স্থাপন করে শব্দদূষণ মাত্রা কমানো যায় ।
(vi) বাড়িতে রেডিও , টিভি, সাউন্ড রেকডিং সিস্টেম প্রভৃতি কম আওয়াজে চালিয়ে, বাজি, পটকা নিষিদ্ধ করে, পুজো প্যান্ডেল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে শব্দদূষণ রোধ করা যায় । এর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে যথাযথ আইন প্রণয়ন দরকার ।
*****