সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (Sanyasi-Fakir Rebellion)

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 18:43

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (Sanyasi-Fakir Rebellion):- ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় ১৭৬৩ থেকে ১৮০০  খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'গিরি' ও 'দাশনামী' সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী ও 'মাদারী' সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে যে কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয়, তা 'সন্ন্যাসী-ফকির' বিদ্রোহ নামে পরিচিত । বাংলায় কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে সন্ন্যাসী ও ফকির সম্প্রদায় । কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের কৃষিকাজের ওপর ব্রিটিশ সরকার ও জমিদাররা ভূমিরাজস্বের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয় । ভূমিরাজস্ব ছাড়াও তাদের ওপর বিভিন্ন রকম কর আরোপ করা হয় । সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে অনেকেই রেশম বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । তাদের থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা জোর করে কাঁচা রেশম ও রেশম পণ্য ছিনিয়ে নিত । সন্ন্যাসীরা মাঝেমধ্যে দল বেঁধে তীর্থস্থানে বের হত । ব্রিটিশ সরকার সন্নাসী-ফকিরদের তীর্থযাত্রার ওপর তীর্থকর চাপায় এবং ফকিরদের পিরস্থান বা দরগায় যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করে তাদের ধর্মাচরণে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে । কোম্পানির কর্মচারীরা ও জমিদাররা সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ওপর নানাভাবে শোষণ ও রাজস্ব আদায়ের জন্য উৎপীড়ন চালাত । এই সব অসন্তোষকে কেন্দ্র করে অত্যাচারিত সন্ন্যাসী ও ফকিররা কোণঠাসা হয়ে পড়লে তারা বিদ্রোহের পথে যায় ।

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূচনা হয় । ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে বাংলা ও বিহারের দরিদ্র কৃষকেরা অন্ন ও বস্ত্রের জন্য সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের ধ্বজা তোলেন । বিদ্রোহের আগুন ক্রমশঃ রাজশাহি, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কোচবিহার, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । উত্তরবঙ্গের 'মাদারি' সম্প্রদায়ের ফকির এবং পূর্ববঙ্গ ও 'ময়মনসিংহের' 'গিরি' ও দাশনামী,  মারাঠা সম্প্রদায়ভুক্ত 'গোঁসাই' এবং শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত নাগা সন্ন্যাসীরা, ভোজপুরি রাও প্রমূখ এই বিদ্রোহে যোগ দেয় । পরে ক্ষমতাচ্যুত জমিদার, ছাঁটাই হওয়া সৈনিক ও বিতাড়িত কৃষক এ বিদ্রোহে যোগ দেয় । এই বিদ্রোহের পটভূমিকায় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'আনন্দমঠ'  উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন । এই বিদ্রোহের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্য ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, কৃপানাথ, মুশা শাহ, মজনু শাহ, পরাগল শাহ, চিরাগ আলি শাহ, অনুপ নারায়ণ, নুরুল মহম্মদ, পীতাম্বর শ্রীনিবাস প্রমুখ অন্যতম ।

বিদ্রোহীরা প্রথমে ঢাকার ইংরেজ কুঠি ও পরে রাজশাহির রামপুর কুঠির ওপর আঘাত হানে । পূর্ণিয়াতে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ বাধে । ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের যুদ্ধে বিদ্রোহীরা ব্রিটিশবাহিনীকে পরাজিত করে ও ইংরেজ সেনাপতি ক্যাপ্টেন টমাসকে হত্যা করে । ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহীদের আক্রমণে ক্যাপটেন এডওয়ার্ডস নিহত হন ও তার বাহিনী বিধ্বস্ত হয় । বিদ্রোহীরা প্রথমদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য পেলেও পরবর্তীকালে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় । ব্রিটিশবাহিনী নিষ্ঠুর দমননীতির দ্বারা বিদ্রোহের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয় ও শেষপর্যন্ত পরাজিত হয় এবং ১৮০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিদ্রোহ থেমে যায় ।  

সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল; প্রথমত, এই বিদ্রোহে হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম ফকিররা একযোগে অংশ নেয় । দ্বিতীয়ত, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় থেকেই নেতৃবর্গ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় । তৃতীয়ত, এই বিদ্রোহে কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক ও মোগল বাহিনীর কর্মচ্যুত সেনারা যোগ দেয় ।

সমকালীন বিভিন্ন তথ্য ও সূত্র থেকে জানা যায় যে, এইসব বিদ্রোহের কারণ ছিল-

(ক) বাংলা ও বিহারে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে করতে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অনেকে কৃষকে পরিণত হয় । ইংরেজরা তাঁদের শোষণপীড়ন করেছিল ।

(খ) বছরের বিশেষ সময়ে এই সন্ন্যাসী ফকির কৃষকরা তীর্থে যেত । কিন্তু ইংরেজরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাদের উপর তীর্থকর বসালে তারা ক্ষুব্দ হয়েছিল ।

(গ) ১১৭৬ সালের মন্বন্তরের সময় ইংরেজদের পৈশাচিক শোষণ ও অত্যাচারের দৃশ্য দেখে বিদ্রোহীরা ইংরেজ, মহাজন ও কিছু জমিদারদের উপর আস্থা হারায় ।

(ঘ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ধার্য করা অত্যধিক রাজস্ব, জমি থেকে ইচ্ছামতো কৃষক উচ্ছেদ প্রভৃতি কারণে বাংলা-বিহারের কৃষকরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় ।

(ঙ) রাজস্ব আদায়ের নামে সার্বিক লুন্ঠন ও কোম্পানির লোকেদের নির্দয় অত্যাচার বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয় । প্রথমে কোম্পানির কুঠি, জমিদারদের কাছারি ও মহাজনদের বাড়ি আক্রমণ করে । ১৭৬৩ -১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুন বেশি প্রজ্বলিত থাকে, রাজশাহির রামপুর ও বোয়ালিয়ার কুঠি এবং ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছাড়িয়ে পড়ে ।

ব্যর্থতার কারণ:

১) সুযোগ্য নেতৃত্ব ও নেতাদের অভিজ্ঞতার অভাব এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা,

২) সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা,

৩) আদর্শহীনতা এবং সাম্প্রদায়িক অনৈক্য,  

৪) উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাব প্রভৃতি কারণে এই চার দশক ধরে চলতে থাকা সন্ন্যাসী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় ।

প্রকৃতিগত বিচারে এই বিদ্রোহকে ব্রিটিশবিরোধী কৃষক সংগ্রাম বলা হয় । এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হলেও উইলিয়াম হান্টার সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন । এটি ছিল পুরো দস্তুর ইংরেজ সরকার বিরোধী কৃষকদের বিদ্রোহ । যদিও লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস একে 'হিন্দুস্থানের যাযাবর' ও 'পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব' বলে চিহ্নিত করেছেন । সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীগণ ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার যে ব্রত গ্রহণ করেন তা পরবর্তীকালে বিদ্রোহীদের উদ্বুদ্ধ করে ।

******

 

Related Items

সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

প্রশ্ন : সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭) চরিত্র বিশ্লেষণ কর ।

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

প্রশ্ন : শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ? উচ্চশিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

প্রশ্ন : নিরাপত্তা পরিষদের কার্যাবলী কী ? সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ও নিরাপত্তা পরিষদের মধ্যে পার্থক্যগুলি উল্লেখ কর ।

নিরাপত্তা পরিষদের কাজ :

বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

প্রশ্ন : বান্দুং সন্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হয় ? এই সন্মেলনের গুরুত্ব নির্ণয় কর । বান্দুং সম্মেলনের নেতৃত্বদানকারী দেশের নাম লেখ ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?

প্রশ্ন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলি কী ?