ভারতীয় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় রায়তওয়ারি ও মহলওয়ারি ব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও ।

Submitted by avimanyu pramanik on Fri, 01/07/2022 - 08:30

প্রশ্ন :-  ভারতীয় ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় রায়তওয়ারি ও মহলওয়ারি ব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও ।

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় জমিদারদের সঙ্গে সরাসরি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় । কিন্তু ভারতের অন্যএ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা বলবৎ করা হয় । এই সব ব্যবস্থার মধ্যে দক্ষিণ ভারতে রায়তওয়ারি ও উত্তর ভারতে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত ছিল উল্লেখযোগ্য ।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত : উনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে ইংরেজদের আধিপত্য সুদৃঢ় হওয়ার পর প্রধানত মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে প্রবর্তিত রায়ত বা প্রকৃত চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি খাজনা আদায়ের সরকারি ব্যবস্থা চালু হয় । এটি ‘রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত । আলেকজান্ডার রীড ও স্যার টমাস মনরো -র উদ্যোগে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে মাদ্রাজ ও পরে বোম্বাই -এ এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত ও সম্প্রসারিত হয় ।

রায়তওয়ারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :-

(১) এই ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় সরকার ও রায়তের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ।

(২) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত অনুসারে কৃষকরা জমির স্বত্ব লাভ করে এবং নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে প্রত্যেক কৃষকের সঙ্গে সাধারণত ৩০ বছরের মেয়াদে জমি বন্দোবস্ত করা হয় ।

(৩) রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে বহু জমিদারের পরিবর্তে এক বিরাট জমিদার অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের রাখা হয় ।

(৪) সাধারণ জমিদারদের তুলনায় সরকারি জমিদারিতে খাজনার পরিমাণ বেশি ধার্য করা হয় যা অনেক সময় কৃষকদের ক্ষমতার অতিরিক্ত ছিল ।

মহলওয়ারি বন্দোবস্ত :  ১৮২২ খ্রস্টাব্দে নিয়মবিধি (Regulation of 1882) জারি করে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, বিশেষভাবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লী এবং পাঞ্জাবে ব্যাক্তিগত ভাবে প্রতিটি কৃষকদের পরিবর্তে প্রতিটি গ্রামের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলে যে রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় তা মহলওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত ।

মহলওয়ারি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :

(১) সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কৃষক বিশেষের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত না করে গ্রামীণ জনগোষ্টীর সঙ্গে তা করা হত ।

(২) প্রতিটি গ্রামের রাজস্বের পরিমাণ মোট হিসাবে স্থির করা হত এবং তা গ্রামের কোনো এক দায়িত্বশীল ব্যাক্তির মাধ্যমে আদায় করা হত ।

(৩) মহলওয়ারি বন্দোবস্তে প্রতি ৩০ বছর অন্তর জমির খাজনা পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রাখা হত, কিন্তু এই বন্দোবস্তের ফলে ব্যাক্তিগত ভাবে কৃষকদের ওপর করের বোঝা বেড়ে যায় ।

পরিণতি : নতুন এইসব ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নানা পরিবর্তন আসে, যেমন—

(১) ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও সেই সঙ্গে নতুন প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতের পূর্বতন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির যেমন— জমিদার, কৃষক ও পঞ্চায়েতদের ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধার বিনাশ ঘটে । এর ফলে ভারতের প্রাচীন গ্রামীণ সামাজিক সংগঠন ভেঙে পড়ে । এই সংগঠন গুলি ছিল কৃষি সম্প্রদায়ের ধারক ।

(২) ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা কৃষকদের পক্ষে মোটেই লাভজনক হয়নি । জমি ক্রয়-বিক্রয় করার, বন্ধক দেওয়ার ও অন্যান্যভাবে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষকদের অবস্থা সঙিন হয়ে ওঠে ।

(৩) এতকাল পর্যন্ত গ্রামীণ জীবনে যে সামাজিক বন্ধন ছিল, তা বিপর্যস্ত হয় । যৌথ পরিবার প্রথা ও পঞ্চায়েতের ওপর চরম আঘাত আসে । গ্রামীন জীবনে সহযোগিতার পরিবর্তে আসে প্রতিযোগিতা । পঞ্চায়েতের প্রভাব–প্রতিপত্তির পরিবর্তে আসে মহাজনদের অত্যাচার ।

(৪) মহাজনদের কাছে দরিদ্র কৃষকদের জমি বন্ধক দেওয়ার রেওয়াজ ক্রমেই কৃষকদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে তোলে ।

নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ জীবনে কৃষকদের পরিবর্তে মহাজন, ভূস্বামী ও সরকারি কর্মচারীদের উদ্ধত নিয়ন্ত্রণ ও শোষণ বলবৎ হয় ।

*****

Comments

Related Items

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা : বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা (Early Stages of Collective Action) : ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় । এই যুদ্ধের একশো বছর পর ১

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে)

পাবনার কৃষকবিদ্রোহ (Peasants' Revolt in Pabna)  :- ১৯৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল্ বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কৃষকরা যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তা '

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt)

নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt) : অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পে নীলের চাহিদা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেলে মুনাফালোভী ইংরেজরা দাদনের জালে আবদ্ধ করে ছলে, বলে, কৌশলে দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের নীলচ

বাংলায় ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement in Bengal)

ফরাজি আন্দোলন (Farazi Movement):- ঊনিশ শতকে বাংলায় সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ফরাজি আন্দোলন । 'ফরাজি' শব্দটি আরবি শব্দ 'ফরজ' থেকে এসেছে । ফরজ শব্দের অর্থ হল 'আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত বাধ্যতামূলক কর্তব্য' । ইসলাম ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে হা

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement in Bengal)

ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi Movement) : ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’ । আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন । ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরি