দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়-অবশিল্পায়ন

Submitted by avimanyu pramanik on Sun, 04/22/2012 - 10:47

দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়-অবশিল্পায়ন (Decline of Indigenous Manufactures)

উনিশ শতকে ভারতীয় শিল্পসমূহের অবক্ষয়ের কারণ হিসাবে রমেশচন্দ্র দত্ত, রজনীপাম দত্ত, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, বিপিন চন্দ্র, অমিয় বাগচী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন যেমন:

(১) দেশীয় শিল্পী ও কারিগরদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজন্য শ্রেণির অবক্ষয়: পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের রাজা, জমিদারসহ অভিজাত শ্রেণির অবক্ষয় ও ক্রম-অবলুপ্তি ভারতীয় কুটিরশিল্পের ওপর চরম আঘাত হানে । কারণ এতদিন পর্যন্ত তারাই ছিলেন ভারতীয় কুটির শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠ পোষক । যেমন দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের কারখানাতেই সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হত । কিন্তু ইংরেজ সরকার ভারতে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র কেনার বদলে তা ব্রিটেন থেকে আমদানি করার পক্ষপাতি ছিলেন । যার ফলশ্রুতি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে তারা কর্মহীন হয়ে পড়ে ।

(২) সরকারের বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি: ইংল্যান্ডের জিনিসপত্র যাতে ভারতে অবাধে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় । অন্যদিকে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর উঁচু হারে শুল্ক ধার্য করা হয় । যেমন ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে ভারতীয় ছাপা সুতিবস্ত্র ও মসলিনের ওপর শুল্কের হার ছিল যথাক্রমে ৬৭.৫% এবং ৩৭.৫% । ভারত থেকে আমদানি করা চিনির ওপর শুল্ক ধার্য করা হত উৎপাদান মূল্যের তিন গুণ বেশি ।

(৩) কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা 'দত্তক' এর অপব্যবহার করে বাংলায় বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য শুরু করে । এই অসাধু ব্যবসার ফলে দেশীয় বণিকদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর থেকে অন্যান্য ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানি একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে । বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূল নীতি ছিল 'যথাসম্ভব কম দামে মাল কিনে তা ইউরোপীয় বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করা' । কোম্পানির এই নীতির ফলে ভারতীয় তাঁতিদের লোকসানের সীমা ছিল না ।

(৪) অবাধ বাণিজ্য নীতি:- ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লোপ পায় এবং অবাধ বাণিজ্যনীতি চালু হয় । আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ইংল্যান্ডের বড় বড় কারখানায় তৈরি সস্তা দামের শিল্পসামগ্রীতে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়, ফলে দেশীয় শিল্প ক্রমশ পিছু হটতে থাকে । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু সময়ের জন্য ইউরোপের বাজারে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ।

(৫) শিল্পবিপ্লব—কোম্পানির ভারসাম্যহীন শিল্পনীতি—ভারতীয় শিল্পের আদিম কৃতকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার অভাব :- ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার ফলে যন্ত্রের সাহায্যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে উন্নত মানের নানান দ্রব্য সামগ্রী বিপুল পরিমাণে উৎপাদন এবং ভারতে তাদের অব্যাহত যোগান ছিল দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ । ইংল্যান্ডের কলকারখানায় উৎপন্ন মানে উন্নত কিন্তু দামে সস্তা পণ্যের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় শিল্প হেরে যায় । অন্যদিকে ভারতীয় শিল্পের আদিম কৃতকৌশল ও দেশীয় শিল্পীদের কারিগরি শিক্ষার অভাব উনিশ শতকে ভারতীয় হস্তশিল্পের ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিল । এই কারনেই রাসব্রুক উইলিয়াম, হ্যামিলটন প্রমুখ ইতিহাসিকরা বলেছেন যে, ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবই ছিল ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ- এর জন্য ব্রিটিশ সরকার বিশেষ দায়ী ছিল না ।

অন্যান্য কারণ :-

(৬) সস্তা দামে বিদেশী পণ্যের আমদানি এবং ভারতীয় নাগরিকদের বিদেশী পণ্যের প্রতি ঝোঁক ।

(৭) দাদন প্রথার কুফল ।

(৮) কাঁচা মালের দাম বৃদ্ধি

(৯) তাঁতিদের ওপর অত্যাচার

(১০) ব্রিটিশ সরকারের পক্ষপাত মূলক শিল্পসংরক্ষণ নীতি, প্রভৃতি ।

দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অর্থনৈতিক ফলাফল

উনিশ শতকে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের ফলে:-

(১) ভারতের হস্তশিল্প এবং বিখ্যাত তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় ।

(২) উনিশ শতকে ভারত শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশ থেকে ওই সমস্ত পণ্যের আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ।

(৩) একসময়ের শিল্পপ্রধান ভারতবর্ষ উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের কাঁচামাল সরবরাহকারী একটি দেশে পরিণত হয় ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দেশীয় বস্ত্রশিল্পের অবনতির কারণ

ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের ঐতিহ্যমন্ডিত বস্ত্রশিল্পের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং কালক্রমে তা ধ্বংস হয়ে যায় । ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের কারণ হিসেবে রমেশচন্দ্র দত্ত, রজনীপাম দত্ত, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, বিপান চন্দ্র, অমিয় বাকচী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন যেমন-

(১) শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী অবাধ বাণিজ্যঃ  ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চ্যার্টার অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লোপ পেয়ে অবাধ বাণিজ্যনীতি চালু হলে ইংল্যান্ডের বৃহদায়তন কলকারখানায় তৈরি সস্তা দামের কাপড়ে ভারতের বাজার ছেয়ে যায়, ফলে ভারতীয় হস্তচালিত বস্ত্র শিল্প ক্রমশ পিছু হটতে থাকে । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু সময়ের জন্য ইউরোপের বাজারে ভারতের রপ্তানি-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায় ।

(২) ব্রিটিশ সরকারের ভারসাম্যহীন শিল্পনীতি ও বৈষম্যমূলক শুল্কনীতি  ইংল্যান্ডের তৈরি জিনিসপত্র যাতে অবাধে ভারতে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় । অন্যদিকে, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের উপর উঁচু হারে শুল্ক ধার্য করা হয় । ব্রিটেনে ভারতের রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্কের হার ছিল অত্যন্ত বেশি । দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে ভারতীয়  ছাপা সুতিবস্ত্র ও মসলিনের ওপর শুল্কের হার ছিল যথাক্রমে ৬৭.৫ শতাংশ এবং ৩৭.৫ শতাংশ ।

(৩) তাঁতিদের ওপর অত্যাচার:-  সুতিবস্ত্র তৈরির জন্য যে তুলার প্রয়োজন হয়, কোম্পানির কর্মচারীরাই তা তাঁতিদের চড়া দামে বিক্রি করত । একদিকে চড়া দামে তুলা কিনে এবং অন্যদিকে কম দামে বস্ত্র বিক্রি করে তাঁতিরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ত— যা ছিল কোম্পানির আমলে দেশীয় বস্ত্রশিল্পের অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ । কোম্পানির দালাল, গোমস্তা ও কর্মচারীদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য গরিষ্ঠসংখ্যক তাঁতিরা নিজেদের পেশা ত্যাগ করে, কেউ কেউ নিজেদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলে । কর্মহীন তাঁতিরা ভূমিহীন খেতমজুরে পরিণত হয় ।

(৪) দাদন প্রথার কুফল :- পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার কর্মচারী, দেশীয় এজেন্ট বা গোমস্তাদের মাধ্যমে তাঁতিদের দাদন বা অগ্রিম দিত বা দাদন নিতে বাধ্য করত । কোম্পানির দাদন গ্রহণ করায় তাঁতিরা অন্য কোথাও উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করতে পারত না এবং কম দামে লোকসান স্বীকার করেও তারা উৎপন্ন বস্ত্র কোম্পানিকে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত ।

সম্পদ নির্গমন:-পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর গোটা অষ্টাদশ শতক ধরে বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যায়, যার বিনিময়ে বাংলা তথা ভারতকে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি । এই ঘটনাকেই অনেক ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ সম্পদ নির্গমন বা আর্থিক নিষ্ক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন । এই ঘটনা পলাশি লুন্ঠন (Plassey plunder) নামেও পরিচিত । দুভাবে ভারত থেকে সম্পদ নির্গমন হয়েছিল, যেমন

(১) নিজস্ব বাণিজ্য ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে নিয়ে যেত ।

(২) এই সময় ব্যাক্তিগত ব্যাবসাবাণিজ্য, নানাবিধ উপঢৌকন ও পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে পরে তা ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিত । ক্লাইভ ছিলেন এই কাজের পথপ্রদর্শক । এইভাবে ভারত থেকে সম্পদের নির্গমন হয়েছিল ।

*****

Related Items

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (The Calcutta Science College) :-

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাংলায় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে । এই সময় স্বদেশি বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মা

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (Indian Association for the Cultivation of science) :-

কায়েমী স্বার্থরক্ষাকারী ও প্রভূত্ববাদী ঔপনিবেশিক বিজ্ঞানচর্চার প্রেক্ষাপটে ঊনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞ

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ

বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশ (Development of Science and Technical Education in Bengal):-

ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য ধাঁচের বিভিন্ন অফিস-আদালত প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কাজের প্রয়োজনে আধুনিক পাশ্চাত্য ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়োজন

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ রায় অ্যান্ড সন্স

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও ইউ রায় অ্যান্ড সন্স (Initiatives Taken by Upendrakishor Roy Choudhury and the U.

ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ

ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ (Press as a Commercial Venture) :

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনবিংশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য ছাপাখানা স্থাপিত হয় । ছাপাখানার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানা কেন্দ্রিক মুদ্রণশিল্প একটি