ভাগীরথী-হুগলী নদীর ওপর বর্জ্যের প্রভাব (Effects of waste disposal on Bhagirathi-Hooghly river) : প্রায় 2500 কিমি দীর্ঘ গঙ্গা নদী ভারতের জীবন রেখা । গঙ্গা নদীর পার্শ্ববর্তী কলকারখানার বর্জ্য, পৌরসভার বর্জ্য, কৃষি ক্ষেত্রের কীটনাশক বাহিত জল ইত্যাদি এই নদীতে এসে পড়ার ফলে নদী আজ দূষিত । মোহানা থেকে 600 কিলোমিটার উত্তর পর্যন্ত গঙ্গা নদীর নিম্নপ্রবাহ ভাগীরথী-হুগলী নামে পরিচিত । এই ভাগীরথী-হুগলি নদীর পুরোটাতেই বর্জ্যের পরিমাণ সর্বাধিক । পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা থেকে গঙ্গাসাগরের মোহানা পর্যন্ত প্রসারিত এই নদীতে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য এসে মিশছে এবং বিভিন্নভাবে ভাগীরথী-হুগলি নদীর জলদূষণ ঘটছে । এর কারণ হল—
(i) ভাগীরথী-হুগলী নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে হুগলী শিল্পাঞ্চল, ফলতা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হলদিয়া শিল্পাঞ্চল ও অসংখ্য কলকারখানা । এই সকল শিল্পকারখানার বিশাল পরিমাণ বর্জ্য ও দূষিত জল অনবরত এই নদীতে এসে পড়ছে ।
(ii) এই নদীর তীর বরাবর গড়ে ওঠা ঘন জনবসতির পয়ঃপ্রণালীর দূষিত বর্জ্য জল ক্রমাগত নদীতে মিশেছে ।
(iii) নদীর তীরে গড়ে ওঠা ট্যানারি, বস্ত্র ও রাসায়নিক শিল্পের বর্জ্যসমূহ এই নদীতে নির্গত হচ্ছে ।
(iv) বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বর্জ্য যেমন ফুল, মালা, কাঠামো প্রভৃতি এবং মৃত পশু এই নদীতে ফেলা হচ্ছে ।
(v) গবাদি পশুর স্নান, কাপড় ধোয়া ও কাচা প্রভৃতিও এই নদীতে হয় বলে ভাগীরথী-হুগলী নদীর জলদূষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ।
(vi) নদীতে যন্ত্রচালিত জলযান চলাচল বৃদ্ধি পাওয়ায় পোড়া মোবিল, ডিজেল, পেট্রোল প্রভৃতি নদীর জলে মিশে জলদূষণ ঘটাচ্ছে ।
এই প্রকার দূষণের ফলে নদীর জলে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রাসায়নিক দূষণের মাত্রাকেও হার মানিয়েছে । ভাগীরথী হুগলী নদীতে বর্জ্যের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এর প্রভাবে —
(i) ২০০৬ সালের পরে এই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে জলবাহিত রোগ যেমন, আমাশয়, কলেরা, হেপাটাইটিস প্রভৃতি রোগের পরিমাণ প্রায় ৬৬% বৃদ্ধি পেয়েছে ।
(ii) প্রতি বছর গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে অসংখ্য শিশু জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ।
(iii) নানা প্রকার বর্জ্য পদার্থ মেশার জন্য নদীর জলের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মের পরিবর্তন ঘটে জল সাংঘাতিকভাবে দূষিত হচ্ছে । বর্তমানে এই নদীর জল পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ।
(iv) বর্জ্যের মাধ্যমে নানা প্রকার বিষাক্ত পদার্থ নদীর জলে মিশে যাওয়ায় এই নদীর জলের বাস্তুতন্ত্র আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে । যেমন — পৃথিবীর অন্যতম স্বাদু জলের ডলফিন, গঙ্গা নদীর ডলফিনের (শুশুক) সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে ।
(v) নদীর দূষিত জল সেচের কাজে ব্যবহার করার জন্য উৎপাদিত ফসলের গুণগত মানের অবনতি ঘটছে ।
সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ (Ganga Action Plan) : ভাগীরথী-হুগলী নদীতে বর্জ্য সমস্যার সমাধানে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে । যেমন—
(i) ১৯৮৪ সালে 'গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান' -এ নদীতে বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস ও তীরবর্তী অঞ্চলে নিকাশিনালা পরিষ্কার এবং পয়ঃপ্রণালী পুনর্গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে ।
(ii) বর্তমানে কলকাতা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন পরিকল্পনায় (KSWMIP) জাপান আন্তর্জাতিক কো-অপারেশন এজেন্সি (JICA) -র সহায়তায় হুগলী শিল্পাঞ্চলে ভাগীরিথী-হুগলী নদীর ডান তীরের ৬টি পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে ।
(iii) সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার গৃহীত 'নমামী গঙ্গে' পরিকল্পনায় গঙ্গা তথা ভাগীরথী-হুগলী নদীতে বর্জ্য দূষণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ।
(iv) দূষিত জল যাতে সরাসরি গঙ্গায় না পড়ে তার জন্য গভীর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে ।
*****