পৃথিবীর তাপবলয় (Temperature belts of the Earth)

Submitted by avimanyu pramanik on Sat, 08/11/2012 - 10:52

পৃথিবীর তাপবলয় (Temperature belts of the Earth) : ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র তাপমাত্রা সমান নয় । বছরের গড় তাপমাত্রা নিম্ন অক্ষাংশে সবচেয়ে বেশি, মাঝামাঝি অঞ্চলে মাঝামাঝি ধরনের এবং মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে কম । অক্ষাংশ অনুসারে বায়ুর উষ্ণতার তারতম্যের ভিত্তিতে পৃথিবীকে প্রধানত তিনটি তাপমন্ডলে ভাগ করা হয়েছে । যেমন —(ক) উষ্ণমণ্ডল, (খ) নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল, (গ) হিম মণ্ডল ।

(ক) উষ্ণমন্ডল (Torrid Belt) : নিরক্ষরেখার উত্তরে ও দক্ষিণে উভয় দিকে ২৩½ অক্ষাংশ পর্যন্ত কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখাদ্বয়ের মধ্যবর্তী ৫,২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত অঞ্চলে সারা বছর সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবে পতিত হয় । ফলে এই অঞ্চলে বার্ষিক গড় উষ্ণতা বেশি হয় । তাই এই অঞ্চলটি উষ্ণমন্ডল নামে পরিচিত । এই অঞ্চলের গড় উষ্ণতা প্রায় ২৭ ° সে. ।

এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য :—

(i) দিনের দৈর্ঘ্যের বিশেষ পার্থক্য হয় না এবং প্রত্যেক স্থানে সূর্যরশ্মি বছরে অন্তত দু’দিন ২১শে মার্চ ও ২৩শে সেপ্টেম্বর মধ্যাহ্নে লম্বভাবে পতিত হয় এবং অন্যান্য সময়েও প্রায় সোজাভাবে পড়ে । সে জন্য সারা বছর ধরে এই অঞ্চল, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে উষ্ণ থাকে ।

(ii) এখানে শীত ও গ্রীষ্মের উষ্ণতার পার্থক্য কম ।

(iii) এই অঞ্চলের যে-কোনো জায়গায় বার্ষিক গড় উষ্ণতা ২৭ সেলসিয়াস বা তার বেশি ।

(iv) যদিও সূর্যের আপাত গতি সাধারণভাবে কর্কটক্রান্তি রেখা (২৩½ উত্তর অক্ষরেখা) ও মকরক্রান্তি রেখার (২৩½ দক্ষিণ অক্ষরেখা) মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু তার প্রভাব আরও কিছু উত্তর ও দক্ষিণে পৌঁছায়, তাই উষ্ণমণ্ডলের প্রকৃত সীমানা নিরক্ষরেখার উভয় পাশে ২৭ সেলসিয়াস সমোষ্ণরেখা পর্যন্ত ধরা হয় ।

(খ) নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল (Temperate Belt) : উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখা (২৩½° উত্তর অক্ষাংশ) থেকে সুমেরুবৃত্ত রেখা (৬৬½° উত্তর অক্ষাংশ) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মকর ক্রান্তি রেখা (২৩½° দক্ষিণ অক্ষাংশ) থেকে কুমেরুবৃত্ত রেখা (৬৬½° দক্ষিণ অক্ষাংশ) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বায়ুর উষ্ণতা মাঝারি ধরনের হয় । সারা বছর মৃদু উষ্ণ ও মৃদু শীতভাব পরিলক্ষিত হয় বলে এই দুটি অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল বলে । এই অঞ্চলটি উত্তর গোলার্ধে উত্তর নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল (North Temperate Belt) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল (South Temperate Belt) নামে পরিচিত । এই অঞ্চলের গড় উষ্ণতা ১০° - ২৭° সে. হয়ে থাকে । নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের যে অংশটি উষ্ণমন্ডলের নিকটে অবস্থিত অর্থাৎ ২৩½° থেকে ৪৫° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে উষ্ণ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল (Warm Temperate Zone) বলে । আবার এই উষ্ণ মন্ডলের যে অংশটি মেরুবৃত্তের নিকটে অবস্থিত অর্থাৎ ৪৫° থেকে ৬৬½° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটি শীতল নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল (Cool Temperate Zone) নামে পরিচিত । এই অঞ্চলে সূর্যরশ্মি খুব তির্যক ভাবে পড়ে না । তাই এই অঞ্চল গ্রীষ্মে খুব একটা উষ্ণ বা শীতে খুব একটা শীতল হয় না ।

(গ) হিমমন্ডল (The Frigid Belt) : উত্তর গোলার্ধে সুমেরুবৃত্ত রেখা অর্থাৎ ৬৬½° উত্তর অক্ষাংশ থেকে সুমেরু অর্থাৎ ৯০° উত্তর অক্ষাংশ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে কুমেরুবৃত্ত রেখা অর্থাৎ ৬৬½° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে কুমেরু অর্থাৎ ৯০° দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বায়ুর উষ্ণতা সারা বছর অত্যন্ত কম থাকে বলে এই দুই অঞ্চলকে হিমমন্ডল বলে । উত্তর গোলার্ধে এই অঞ্চলকে উত্তর হিমমণ্ডল (North Frigid Belt) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এই অঞ্চলকে দক্ষিণ হিমমণ্ডল (South Frigid Belt) বলে । এই অঞ্চলের গড় উষ্ণতা 0° সে. -এরও কম এবং প্রায় সারা বছর বরফাবৃত থাকে । সমোষ্ণরেখা অনুসারে 0 সেলসিয়াস সমোষ্ণরেখা থেকে উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত অঞ্চলকে হিমমণ্ডল ধরা হয় ।  

এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য:-

(i) এই অঞ্চলে সূর্যের অবনতি বছরের সব সময় ৪৩ -র বেশি থাকে এবং সূর্যরশ্মি একেবারে তির্যকভাবে পড়ে ।

(ii) এই অঞ্চলের সর্বত্রই বছরের অন্তত একদিন আকাশে সূর্যকে দেখাই যায় না ।

(iii) উত্তর ও দক্ষিণ মেরুবিন্দুতে একসঙ্গে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি হয় ।

(iv) এই সমস্ত কারণে এই স্থান দুটি অত্যন্ত শীতল ।

(v) এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ২৪ ঘন্টা থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সূর্য একেবারেই অস্ত যায় না, তাই এই অঞ্চলকে ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ বলে ।

(vi) মেরু অঞ্চলে ছয় মাস ব্যাপী অন্ধকারের সময় আকাশে মাঝে মাঝে রামধনুর মতো অস্পষ্ট আলো দেখা যায় যাকে সুমেরু অঞ্চলে সুমেরু প্রভা ও কুমেরু অঞ্চলে কুমেরু প্রভা বলে ।

সমোষ্ণরেখা (Isotherm line) : ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র তাপমাত্রা সমান নয় । ভূপৃষ্ঠের যে সকল স্থানের গড় উষ্ণতা সমান বা একই রকম থাকে, মানচিত্রে সেই সকল স্থানগুলিকে পরস্পর যোগ করে যে কাল্পনিক রেখা টানা হয়, তাকে সমোষ্ণরেখা বলে । অর্থাৎ, যে কাল্পনিক রেখা দিয়ে বছরের একই সময়ে একই উষ্ণতা বিশিষ্ট স্থানগুলি মানচিত্রে যোগ করা হয় তাকে সমোষ্ণরেখা বলে । সমোষ্ণরেখাগুলি সাধারণত জুলাই ও জানুয়ারি মাসের গড় উষ্ণতার সাপেক্ষে টানা হয়ে থাকে । ভূপৃষ্ঠের সকল স্থান সমুদ্রতল থেকে সমান উঁচু বা নীচু নয় বলে পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানের উষ্ণতাকে সমুদ্রতলের উষ্ণতায় রূপান্তরিত করে সমোষ্ণরেখাগুলি টানা হয় । সমোষ্ণরেখার মানচিত্রের সাহায্যে পৃথিবীর নানা স্থানে উষ্ণতার বিস্তৃতি সম্বন্ধে ধারণা করা যায় ।

সমোষ্ণরেখার বৈশিষ্ট্য :

(i) সমোষ্ণরেখাগুলি অক্ষরেখার সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত হয় ।

(ii) স্থলভাগ ও জলভাগের প্রকৃতিগত তারতম্যে সমোষ্ণরেখাগুলি জলভাগ ও স্থলভাগের মিলনস্থল বরাবর কিছুটা বেঁকে যায় ।

(iii) উত্তর গোলার্ধে জানুয়ারি মাসে সমোষ্ণরেখাগুলি শীতল স্থলভাগের ওপর নিরক্ষরেখার দিকে এবং উষ্ণ স্থলভাগের ওপর মেরুর দিকে বেঁকে যায় । আবার জুলাই মাসে ঠিক এর বিপরীত অবস্থা পরিলক্ষিত হয় ।

(iv) উত্তর গোলার্ধে জানুয়ারি মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে জুলাই মাসে সমোষ্ণরেখাগুলি পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করে । 

****

Related Items

নর্মদা নদী (The Narmada)

নর্মদা নদী (The Narmada) : মহাকাল পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অমরকন্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে নর্মদা নদী উত্তর-পশ্চিমে বেঁকে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র হয়ে গুজরাটের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরার সংকীর্ণ গিরিখাত অতিক্রম করে

ব্রহ্মপুত্র নদ (The Brahmaputra)

ব্রহ্মপুত্র নদ : তিব্বতের মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমায়ুং-দুং হিমবাহ থেকে সাংপো নামে উৎপন্ন হয়ে নামচাবারওয়া শৃঙ্গের কাছে চুলের কাটার মত বেঁকে অরুণাচল প্রদেশের মধ্য দিয়ে ডিহং নামে ভারতে প্রবেশ করেছে । এর মোট দৈর্ঘ্য ২,৯০০ কিমি, এর মধ্

সিন্ধু নদ (The Indus)

সিন্ধু নদ : সিন্ধু নদ তিব্বতের মানস সরোবরের উত্তরে অবস্থিত সিন-কা-বাব জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়ে উত্তর-পশ্চিমে প্রথমে তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে লাদাখ অঞ্চল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে । সিন্ধু নদের মোট দৈর্ঘ্য ৩,১৮০ কিমি এবং এর মধ

গঙ্গা নদী (The Ganges)

গঙ্গা নদী : গঙ্গা ভারতের শ্রেষ্ঠ নদী এবং ভারতের দীর্ঘতম নদী । গঙ্গানদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫১০ কিমি এবং এর মধ্যে ২০১৭ কিমি ভারতে প্রবাহিত । কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ তুষার গুহা থেকে ভাগীরথী নামে উৎপন্ন হয়ে সংকীর্ণ গিরিখাতের

ভারতের নদনদী (Rivers of India)

ভারতের নদনদী : ভারতে অসংখ্য নদনদী বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে । উৎস, প্রবাহের অঞ্চল, এবং মোহানা অনুসারে ভারতের নদনদীকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যেমন— (১) উত্তর ভারতের নদী এবং (২) দক্ষিণ ভারতের নদী ।