উত্তরের সমভূমি অঞ্চল (The Northern Plains)

Submitted by avimanyu pramanik on Mon, 12/20/2021 - 15:32

উত্তরের সমভূমি অঞ্চল (The Northern Plains) : উত্তরে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণে উপদ্বীপীয় মালভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এবং এদের বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীগুলি পলি সঞ্চয় করে যে বিস্তৃত সমতলভূমি গঠন করেছে তাকে উত্তরের সমভূমি অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয় । সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই সমভূমি অঞ্চলটি ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম সঞ্চয়জাত সমভূমি অঞ্চল । এই সমভূমি অঞ্চলটি হল ভারতের সবচেয়ে উর্বর ও জনবহুল অঞ্চল । এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫০০ কিমি. এবং বিস্তার ২৫০ কিমি. থেকে ৩৫০ কিমি. ।

ভূপ্রকৃতি : এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি সমতল ও বৈচিত্র্যহীন । ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুসারে এই উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি অঞ্চলটিকে এক সময় চার ভাগে ভাগ করা হত । যেমন—

(i) ভাবর অঞ্চল : হিমালয়ের পাদদেশে নদীবাহিত নুড়ি, পাথর প্রভৃতি সঞ্চিত ঈষৎ ঢেউখেলানো ভূমিকে ভাবর বলা হয় ।

(ii) তরাই অঞ্চল : ভাবর অঞ্চলের দক্ষিণে নবীন পলিগঠিত অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমি অঞ্চলকে তরাই অঞ্চল বলে ।

(iii) ভাঙ্গর অঞ্চল : গঙ্গা সমভূমির প্লাবন অববাহিকায় প্রাচীন পলি সঞ্চিত হয়ে যে ধাপযুক্ত ভূমি গঠিত হয়েছে, তাকে ভাঙ্গর অঞ্চল বলা হয় ।

(iv) খাদার অঞ্চল : ভাঙ্গর অঞ্চলের পরে নিম্নভূমি এলাকায় একেবারে নতুন পলিগঠিত ভূমি উত্তরপ্রদেশে খাদার ও পাঞ্জাবে বেট নামে পরিচিত ।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । যথা—

(১) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি, (২) গঙ্গা সমভূমি, (৩) পাঞ্জাব সমভূমি এবং (৪) ভারতীয় মরু সমভূমি অঞ্চল ।

(১) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি (The Brahmaputra Plains): উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের পূর্বদিকে সমগ্র অসম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার উপনদীর পলি সঞ্চিত হয়ে এই সমভূমি অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে । এই অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭৫০ কিমি. এবং বিস্তার ৮০ কিমি. । এই সমভূমি অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথে অসংখ্য বালুচর বা দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে । ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী মধ্যবর্তী দ্বীপ 'মাজুলি' গড়ে উঠেছে ।

(২) গঙ্গা সমভূমি (The Ganga Plains) : এই অঞ্চলটি উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিস্তৃত । পশ্চিমে যমুনা নদী থেকে শুরু করে পূর্বে হুগলি নদীর মোহানা পর্যন্ত বিস্তৃত এই সমতলভূমিটি গঙ্গা ও তার বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে । পূর্ব-পশ্চিমে অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৩৫০ কিমি. এবং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তার ২৪০ কিমি থেকে ৩২০ কিমি. । এই সমভূমির নদীতীরবর্তী কোনো কোনো এলাকায় প্লাবনভূমি, স্বাভাবিক বাঁধ, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ প্রভৃতি দেখা যায় । সমগ্র এলাকাটি পশ্চিম থেকে পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে ঢালু । ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গঙ্গা সমভূমি অঞ্চলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত । যথা— (i) উচ্চগঙ্গা সমভূমি, (ii) মধ্যগঙ্গা সমভূমি, (iii) নিম্নগঙ্গা সমভূমি ।

(i) উচ্চগঙ্গা সমভূমি : এই সমভূমি অঞ্চলটি গঙ্গা-যমুনা দোয়াব, রোহিলখন্ড সমভূমি, অযোধ্যা সমভূমি ও যমুনা পার সমভূমি নিয়ে গঠিত এবং পশ্চিমে যমুনা নদী থেকে পূর্বে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত । দুটি নদীর মধ্যবর্তী পলিগঠিত সামান্য উঁচু ভূমিকে দোয়াব বলে ।

(ii) মধ্যগঙ্গা সমভূমি : এলাহাবাদ থেকে পূর্বে বিহারের রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলটিকে মধ্যগঙ্গা সমভূমি অঞ্চল বলে । এই অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ১০০ মি. ।

(iii) নিম্নগঙ্গা সমভূমি : রাজমহল পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহানা পর্যন্ত প্রসারিত এই অঞ্চলটিকে নিম্নগঙ্গা সমভূমি অঞ্চল বলে । এই অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ২০ মিটারেরও কম ।

(৩) পাঞ্জাব সমভূমি (The Punjab-Haryana Plans) : পাঞ্জাব সমভূমি অঞ্চলটি পূর্বে যমুনা নদী থেকে পশ্চিমে শতদ্রু ও বিপাশা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত । সিন্ধু নদের উপনদী ইরাবতী, শতদ্রু, ইরাবতী ও বিপাশা নদীসমূহের পলি সঞ্চয়ের ফলে গঠিত বলে পাঞ্জাবকে 'পঞ্চনদের দেশ' বলা হয় । অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ২০০ মিটার । ইরাবতী ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী বারি দোয়াব বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এই সমভূমির দক্ষিণ, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশে কিছু পাহাড়ি ভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ।

(৪) ভারতীয় মরু সমভূমি অঞ্চল (The Plains of Rajasthan) : ভারতের পশ্চিমে রাজস্থান রাজ্যের পশ্চিম দিকে অবস্থিত বিখ্যাত থর মরুভূমির ভারতের অংশটি ভারতীয় মরু অঞ্চল বা মরুস্থলী নামে পরিচিত । 'মরুস্থলী' শব্দের অর্থ মৃতের দেশ ।  প্রধানত বালি, পাথর, বালিয়াড়ি ও উঁচু ঢিবি দ্বারা গঠিত এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ১৫০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার । এই অঞ্চলের লবণাক্ত জলের হ্রদগুলি স্থানীয়ভাবে 'রণ' নামে পরিচিত । সম্বর, দিদওয়ানা, কুচামন প্রভৃতি রণ উল্লেখযোগ্য । লুনী এই অঞ্চলের একমাত্র বড় নদী । ভারতের মরুভূমি অঞ্চলের উত্তরে পাঞ্জাব সমভূমি, দক্ষিণে গুজরাট সমভূমি, পূর্বে আরবল্লী পর্বতশ্রেণি এবং পশ্চিমে পাকিস্তানের মরু অঞ্চল অবস্থিত । ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভারতীয় মরু অঞ্চলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় । যেমন—

(i) মরু অঞ্চলের একেবারে পশ্চিম সীমান্তে অবস্থান করছে বালুকাময় মরুভূমি বা আর্গ অঞ্চল ।

(ii) আর্গ অঞ্চলের পূর্বে রয়েছে প্রস্তরময় মরুভূমি বা হামাদা অঞ্চল ।

(iii) হামাদা অঞ্চলের পূর্বে অবস্থিত ক্ষুদ্র মরু অঞ্চল ।

(iv) ক্ষুদ্র মরু অঞ্চলের পূর্বদিকে আরাবল্লী পর্বতের পাদদেশীয় অংশটি বাগার অঞ্চল নামে পরিচিত ।

(v) বাগার অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থান করছে পলিগঠিত রোহি অঞ্চল । 

সমভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব :

(১) সমভূমি অঞ্চল উর্বর পলিগঠিত হওয়ায় এই অঞ্চলটি কৃষিকাজের উপযোগী ।

(২) সমতল ভূমিরূপের কারণে সমভূমি অঞ্চলে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ।

(৩) আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ও কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধার কারণে এই অঞ্চল শিল্পেও উন্নত ।

(৪) জীবিকা অর্জনের সুযোগ থাকায় সমভূমি অঞ্চল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ।

(৫) জীবনজীবিকা অনায়াসসাধ্য বলে সমভূমি অঞ্চলের অধিবাসীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চায় যথেষ্ট উন্নত ।

*****

Comments

Related Items

ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি কাকে বলে ও এর বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা কর এবং কীভাবে সৃষ্টি হয় ?

প্রশ্ন:- ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি কাকে বলে ও এর বৈশিষ্ট্যগুলি বর্ণনা কর এবং কীভাবে সৃষ্টি হয় ?

পর্বতবেষ্টিত মালভূমি কাকে বলে এবং কি ভাবে সৃষ্টি হয় ?

প্রশ্ন :- পর্বতবেষ্টিত মালভূমি কাকে বলে এবং কি ভাবে সৃষ্টি হয় ?

মালভূমির বৈশিষ্ট্যগুলি কী ? মালভূমি সৃষ্টির কারণগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।

প্রশ্ন:-  মালভূমির বৈশিষ্ট্যগুলি কী ? মালভূমি সৃষ্টির কারণগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।

উত্তর:  সমুদ্র সমতল থেকে ৩০০ মিটার উঁচু, চারপাশে খাড়া ঢাল যুক্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকে মালভূমি বলে ।

ক্ষয়জাত পর্বত কাকে বলে ? ক্ষয়জাত পর্বতের সঙ্গে আগ্নেয় পর্বতের কী কী পার্থক্য ?

প্রশ্ন: - ক্ষয়জাত পর্বত কাকে বলে ? ক্ষয়জাত পর্বতের সঙ্গে আগ্নেয় পর্বতের কী কী পার্থক্য ?

অগ্নুৎপাতের বৈশিষ্ট্য অনুসারে আগ্নেয় পর্বতের শ্রেণিবিভাগ কর ও আগ্নেয় পর্বতের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ?

প্রশ্ন:- অগ্নুৎপাতের বৈশিষ্ট্য অনুসারে আগ্নেয় পর্বতের শ্রেণিবিভাগ কর ও আগ্নেয় পর্বতের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী ?