উত্তরের সমভূমি অঞ্চল (The Northern Plains) : উত্তরে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণে উপদ্বীপীয় মালভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এবং এদের বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীগুলি পলি সঞ্চয় করে যে বিস্তৃত সমতলভূমি গঠন করেছে তাকে উত্তরের সমভূমি অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয় । সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই সমভূমি অঞ্চলটি ভারত তথা বিশ্বের বৃহত্তম সঞ্চয়জাত সমভূমি অঞ্চল । এই সমভূমি অঞ্চলটি হল ভারতের সবচেয়ে উর্বর ও জনবহুল অঞ্চল । এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৫০০ কিমি. এবং বিস্তার ২৫০ কিমি. থেকে ৩৫০ কিমি. ।
ভূপ্রকৃতি : এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি সমতল ও বৈচিত্র্যহীন । ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুসারে এই উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি অঞ্চলটিকে এক সময় চার ভাগে ভাগ করা হত । যেমন—
(i) ভাবর অঞ্চল : হিমালয়ের পাদদেশে নদীবাহিত নুড়ি, পাথর প্রভৃতি সঞ্চিত ঈষৎ ঢেউখেলানো ভূমিকে ভাবর বলা হয় ।
(ii) তরাই অঞ্চল : ভাবর অঞ্চলের দক্ষিণে নবীন পলিগঠিত অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমি অঞ্চলকে তরাই অঞ্চল বলে ।
(iii) ভাঙ্গর অঞ্চল : গঙ্গা সমভূমির প্লাবন অববাহিকায় প্রাচীন পলি সঞ্চিত হয়ে যে ধাপযুক্ত ভূমি গঠিত হয়েছে, তাকে ভাঙ্গর অঞ্চল বলা হয় ।
(iv) খাদার অঞ্চল : ভাঙ্গর অঞ্চলের পরে নিম্নভূমি এলাকায় একেবারে নতুন পলিগঠিত ভূমি উত্তরপ্রদেশে খাদার ও পাঞ্জাবে বেট নামে পরিচিত ।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে উত্তরের সমভূমি অঞ্চলকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় । যথা—
(১) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি, (২) গঙ্গা সমভূমি, (৩) পাঞ্জাব সমভূমি এবং (৪) ভারতীয় মরু সমভূমি অঞ্চল ।
(১) ব্রহ্মপুত্র সমভূমি (The Brahmaputra Plains): উত্তরের সমভূমি অঞ্চলের পূর্বদিকে সমগ্র অসম রাজ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার উপনদীর পলি সঞ্চিত হয়ে এই সমভূমি অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে । এই অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭৫০ কিমি. এবং বিস্তার ৮০ কিমি. । এই সমভূমি অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথে অসংখ্য বালুচর বা দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে । ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী মধ্যবর্তী দ্বীপ 'মাজুলি' গড়ে উঠেছে ।
(২) গঙ্গা সমভূমি (The Ganga Plains) : এই অঞ্চলটি উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিস্তৃত । পশ্চিমে যমুনা নদী থেকে শুরু করে পূর্বে হুগলি নদীর মোহানা পর্যন্ত বিস্তৃত এই সমতলভূমিটি গঙ্গা ও তার বিভিন্ন উপনদী ও শাখানদীর পলি সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে । পূর্ব-পশ্চিমে অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৩৫০ কিমি. এবং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তার ২৪০ কিমি থেকে ৩২০ কিমি. । এই সমভূমির নদীতীরবর্তী কোনো কোনো এলাকায় প্লাবনভূমি, স্বাভাবিক বাঁধ, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ প্রভৃতি দেখা যায় । সমগ্র এলাকাটি পশ্চিম থেকে পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে ঢালু । ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গঙ্গা সমভূমি অঞ্চলটিকে তিন ভাগে বিভক্ত । যথা— (i) উচ্চগঙ্গা সমভূমি, (ii) মধ্যগঙ্গা সমভূমি, (iii) নিম্নগঙ্গা সমভূমি ।
(i) উচ্চগঙ্গা সমভূমি : এই সমভূমি অঞ্চলটি গঙ্গা-যমুনা দোয়াব, রোহিলখন্ড সমভূমি, অযোধ্যা সমভূমি ও যমুনা পার সমভূমি নিয়ে গঠিত এবং পশ্চিমে যমুনা নদী থেকে পূর্বে এলাহাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত । দুটি নদীর মধ্যবর্তী পলিগঠিত সামান্য উঁচু ভূমিকে দোয়াব বলে ।
(ii) মধ্যগঙ্গা সমভূমি : এলাহাবাদ থেকে পূর্বে বিহারের রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলটিকে মধ্যগঙ্গা সমভূমি অঞ্চল বলে । এই অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ১০০ মি. ।
(iii) নিম্নগঙ্গা সমভূমি : রাজমহল পাহাড় থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহানা পর্যন্ত প্রসারিত এই অঞ্চলটিকে নিম্নগঙ্গা সমভূমি অঞ্চল বলে । এই অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ২০ মিটারেরও কম ।
(৩) পাঞ্জাব সমভূমি (The Punjab-Haryana Plans) : পাঞ্জাব সমভূমি অঞ্চলটি পূর্বে যমুনা নদী থেকে পশ্চিমে শতদ্রু ও বিপাশা নদীর অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত । সিন্ধু নদের উপনদী ইরাবতী, শতদ্রু, ইরাবতী ও বিপাশা নদীসমূহের পলি সঞ্চয়ের ফলে গঠিত বলে পাঞ্জাবকে 'পঞ্চনদের দেশ' বলা হয় । অঞ্চলটির গড় উচ্চতা ২০০ মিটার । ইরাবতী ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী বারি দোয়াব বিশেষ উল্লেখযোগ্য । এই সমভূমির দক্ষিণ, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশে কিছু পাহাড়ি ভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ।
(৪) ভারতীয় মরু সমভূমি অঞ্চল (The Plains of Rajasthan) : ভারতের পশ্চিমে রাজস্থান রাজ্যের পশ্চিম দিকে অবস্থিত বিখ্যাত থর মরুভূমির ভারতের অংশটি ভারতীয় মরু অঞ্চল বা মরুস্থলী নামে পরিচিত । 'মরুস্থলী' শব্দের অর্থ মৃতের দেশ । প্রধানত বালি, পাথর, বালিয়াড়ি ও উঁচু ঢিবি দ্বারা গঠিত এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ১৫০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার । এই অঞ্চলের লবণাক্ত জলের হ্রদগুলি স্থানীয়ভাবে 'রণ' নামে পরিচিত । সম্বর, দিদওয়ানা, কুচামন প্রভৃতি রণ উল্লেখযোগ্য । লুনী এই অঞ্চলের একমাত্র বড় নদী । ভারতের মরুভূমি অঞ্চলের উত্তরে পাঞ্জাব সমভূমি, দক্ষিণে গুজরাট সমভূমি, পূর্বে আরবল্লী পর্বতশ্রেণি এবং পশ্চিমে পাকিস্তানের মরু অঞ্চল অবস্থিত । ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভারতীয় মরু অঞ্চলকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় । যেমন—
(i) মরু অঞ্চলের একেবারে পশ্চিম সীমান্তে অবস্থান করছে বালুকাময় মরুভূমি বা আর্গ অঞ্চল ।
(ii) আর্গ অঞ্চলের পূর্বে রয়েছে প্রস্তরময় মরুভূমি বা হামাদা অঞ্চল ।
(iii) হামাদা অঞ্চলের পূর্বে অবস্থিত ক্ষুদ্র মরু অঞ্চল ।
(iv) ক্ষুদ্র মরু অঞ্চলের পূর্বদিকে আরাবল্লী পর্বতের পাদদেশীয় অংশটি বাগার অঞ্চল নামে পরিচিত ।
(v) বাগার অঞ্চলের পূর্বদিকে অবস্থান করছে পলিগঠিত রোহি অঞ্চল ।
সমভূমি অঞ্চলের গুরুত্ব :
(১) সমভূমি অঞ্চল উর্বর পলিগঠিত হওয়ায় এই অঞ্চলটি কৃষিকাজের উপযোগী ।
(২) সমতল ভূমিরূপের কারণে সমভূমি অঞ্চলে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ।
(৩) আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ও কাঁচামাল সংগ্রহের সুবিধার কারণে এই অঞ্চল শিল্পেও উন্নত ।
(৪) জীবিকা অর্জনের সুযোগ থাকায় সমভূমি অঞ্চল অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ ।
(৫) জীবনজীবিকা অনায়াসসাধ্য বলে সমভূমি অঞ্চলের অধিবাসীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পচর্চায় যথেষ্ট উন্নত ।
*****