রেচনের সংজ্ঞা এবং তার ব্যাখ্যা

Submitted by arpita pramanik on Fri, 11/23/2012 - 00:08

রেচনের সংজ্ঞা এবং তার ব্যাখ্যা (Definition and Explanation of Excretion)

জীবদেহে বিপাক ক্রিয়ার ফলে উত্পন্ন অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক উপজাত দ্রব্যসমূহ যে জৈবিক ক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ থেকে অপসারিত হয় অথবা অদ্রাব্য কোলয়েড কণা হিসেবে দেহের কোনও অংশে সাময়িক ভাবে সঞ্চিত থাকে, সেই জৈবনিক ক্রিয়াকে রেচন [Excretion] বলে ।

রেচন অঙ্গ ও তন্ত্র (Excretory organs and system)

উদ্ভিদের কোনো নির্দিষ্ট রেচন অঙ্গ ও রেচন তন্ত্র থাকে না ।  প্রাণীদেহে রেচন ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কতকগুলি নির্দিষ্ট যন্ত্র থাকে । রেচনে সাহায্যকারী এই যন্ত্রগুলিকে রেচন অঙ্গ [Excretory Organs] বলে । রেচনে সাহায্যকারী অঙ্গগুলো মিলিত হয়ে যে তন্ত্র গঠিত হয় তাকে রেচনতন্ত্র [Excretory System] বলে । এককোষী প্রাণীদের নির্দিষ্ট কোনো রেচন অঙ্গ বা তন্ত্র থাকে না, এদের সংকোচি গহ্বর এবং কোষপর্দা রেচনে সহায়তা করে । স্পঞ্জ এবং হাইড্রার দেহেও কোনও  নির্দিষ্ট   রেচন থাকে না । চ্যাপ্টা কৃমিদের (প্লানোরিয়া, ফিতাকৃমি ইত্যাদি) রেচন অঙ্গ হল ফ্লেমকোষ বা শিখাকোষ [flame cells] । কেঁচো, জোঁক, পেরিপেটাস এবং অ্যাম্পিঅক্সাসের রেচন অঙ্গ হল নেফ্রিডিয়া [nephridia] । পতঙদের ( আরশোলা, ফড়িং, প্রজাপতি, মশা ইত্যাদি ) রেচন অঙ্গ হল ম্যালপিজিয়ান নালিকা [malpighian tubules]। চিংড়ির রেচন অঙ্গ হল সবুজ গ্রন্থি বা শুঙ্গ গ্রন্থি [green gland] । মাকড়সা ও কাঁকড়া বিছের রেচন অঙ্গ হল কক্সাল গ্রন্থি [coxal gland] । শামুক, ঝিনুক এবং মাছ থেকে স্তন্যপায়ী পর্যন্ত সমস্ত মেরুদন্ডী প্রাণীদের রেচন অঙ্গ হল বৃক্ক বা কিডনী [kidney] ।

রেচন পদার্থ (Excretory products):-  জীব দেহকোষে উত্পন্ন বিপাকজাত দূষিত পদার্থগুলোকে রেচন পদার্থ [Excretory products] বলা হয় । মল বিপাক ক্রিয়ায় উত্পন্ন হয় না বলে মলকে রেচন পদার্থ বলা হয় না ।  প্রাণীদেহে অপাচ্য খাদ্য বিশেষ প্রক্রিয়ায় মলে পরিণত হয় এবং প্রয়োজনকালে দেহ থেকে বর্জপদার্থ হিসাবে নির্গত হয় । 

উদ্ভিদ ও প্রাণীর রেচন পদার্থগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যেতে পারে, যথা:-

(i) নাইট্রোজেনবিহীন রেচন পদার্থ:- উদ্ভিদের গঁদ, রজন, তরুক্ষীর, ধাতব কেলাস ইত্যাদি এবং প্রাণীদের কার্বন ডাই-অক্সাইড, কিটোনবডি হল নাইট্রোজেনবিহীন রেচন পদার্থ ।

(ii) নাইট্রোজেনযুক্ত রেচন পদার্থ:- উদ্ভিদের উপক্ষার ; যেমন নিকোটিন, কুইনাইন, ডাটুরিন, রেসারপিন, এবং প্রাণীদের ইউরিয়া,  অ্যামোনিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, বিলিরুবিন, বিলিভারডিন প্রভৃতি হল নাইট্রোজেনযুক্ত রেচন পদার্থ । 

(iii) কার্বনযুক্ত রেচন পদার্থ:- উদ্ভিদের ট্যানিন এবং প্রাণীদের কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ।

রেচনের গুরুত্ব (Importance of Excretion)

জীবদেহে রেচনের নানা রকমের গুরুত্ব রয়েছে যেমন:-

[i]  জীবদেহের সুস্থতা রক্ষা:- যেহেতু রেচন পদার্থ ক্ষতিকর তাই দেহ থেকে রেচন পদার্থ অপসারিত হয়ে জীবদেহের স্বাভাবিক সুস্থতা বজায় রাখে ।  

[ii]  প্রোটোপ্লাজমীয় বস্তুর সমতা রক্ষা:- প্রতিটি কোষের প্রোটোপ্লাজমে অবিরাম বিপাকীয় ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে । অপচিতি বিপাকের ফলে যেসব দূষিত পদার্থের সৃষ্টি হয় সেগুলি কোষ থেকে দূরীভূত না হলে প্রোটোপ্লাজমের বিপাকীয় ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কোষের মৃত্যু ঘটত, সুতরাং রেচন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রোটোপ্লাজম থেকে দুষিত পদার্থের অপসারণ ঘটে -এর ফলে প্রোটোপ্লাজমীয় বিভিন্ন বস্তুর পরিমাণের সমতা বজায় থাকে এবং বিপাকীয় ক্রিয়া গুলি স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়ে থাকে । 

[iii]  প্রাকৃতিক সম্পদের আবর্তন:- জীব পরিবেশ থেকে যে সব মৌলগুলি গ্রহন করে, রেচনের মাধ্যমে অধিকাংশ মৌল পরিবেশে ফিরিয়ে দিয়ে পরিবেশে মৌলগুলির স্বকীয়তা বজায় রাখে ।

[iv]  অর্থনৈতিক গুরুত্ব:- উদ্ভিদের বিভিন্ন রেচন পদার্থ মানুষের নানান কাজে লাগে । ভেষজ শিল্পে, চর্মশিল্পে, আঠা প্রস্তুতিতে এবং কাষ্ঠশিল্প ইত্যাদিতে উদ্ভিদ রেচন পদার্থের অপরিসীম অর্থকরী গুরুত্ব রয়েছে ।

রেচনের  উদ্দেশ্য:- কলা কোষে উত্পন্ন বিপাকজাত দুষিত পদার্থগুলিকে কোষ থেকে অপসারণ করা এবং প্রোটোপ্লাজমের জীবজ ক্রিয়া গুলোকে স্বাভাবিক রাখাই হল রেচনের প্রধান উদ্দেশ্য । 

*****

Related Items

উদ্ভিদ ও প্রাণীর রেচন ক্রিয়ার পার্থক্য

রেচন পদার্থ নিষ্কাশনের জন্য উদ্ভিদ দেহে কোনও নির্দিষ্ট অঙ্গ থাকে না । এরা পত্রমোচন, বাকল মোচন, গঁদ নিঃসরণের মাধ্যমে রেচন পদার্থ ত্যাগ করে । প্রাণীর দেহে রেচন পদার্থ নিষ্কাশনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ ও তন্ত্র থাকে । অধিকাংশ উদ্ভিদ তাদের রেচন পদার্থ গুলোকে অদ্রাব্য কেলাস বা ...

প্রাণীর রেচনে ত্বক বা চর্ম, ফুসফুস এবং যকৃতের ভূমিকা

প্রাণীদেহের অন্যান্য সাহায্যকারী রেচন অঙ্গগুলি হল চর্ম, ফুসফুস, এবং যকৃৎ। চর্ম প্রাণীদের পেশিকে আচ্ছাদন করে রাখে, ফলে এর প্রধান কাজ রক্ষণাত্মক । তা ছাড়া চর্ম স্পর্শেন্দ্রিয়রূপেও কাজ করে। চর্মের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রেচনে সহায়তা করা। চর্মে অবস্থিত ঘর্মগ্রন্থি ...

বৃক্কের মাধ্যমে নাইট্রোজেন জাতীয় বর্জ্যপদার্থের বহিষ্করণ

দেহের অব্যবহৃত প্রোটিন ডি-অ্যামাইনেজ নামে একরকমের উৎসেচকের প্রভাবে অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয় । এই অ্যামোনিয়া যকৃতে এসে আরজিনেজ নামে এক রকমের উৎসেচকের সহায়তায় অরনিথিন চক্রের মাধ্যমে ইউরিয়ায় পরিণত হয় । এই ইউরিয়া এবং অন্যান্য রেচন পদার্থযুক্ত রক্ত ...

নেফ্রন (Nephron)

নেফ্রন হল কিডনি বা বৃক্কের গঠনগত ও কার্যগত একক, যা প্রধানত ম্যালপিজিয়াম করপাসল এবং বৃক্কীয় নালিকা নিয়ে গড়ে ওঠে এবং মুত্র তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে । প্রতিটি মানব বৃক্কে প্রায় দশ লক্ষ করে নেফ্রন থাকে । প্রতিটি নেফ্রন প্রধানত তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত, যথা ...

মানবদেহের রেচন ক্রিয়া

মানব দেহের রেচন অঙ্গ হল বৃক্ক । এছাড়া চর্ম, ফুসফুস, যকৃৎ ইত্যাদি রেচনে সাহায্য করে বলে এদের সহায়ককারী রেচন অঙ্গ বলে । মানবদেহের রেচন তন্ত্র এক জোড়া বৃক্ক, এক জোড়া গবিনী, একটি মুত্রাশায়, এবং একটি মুত্রনালী নিয়ে গঠিত । মানুষের বৃক্ক দুটি দেখতে শিমের বীজের মতো ...