আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ (Development of The Regional Languages and Literature during the Sultanate Period) :
(১) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (Bengali Languages and Literature) : সুলতানি ও মুঘল আমল ছিল বাংলা সাহিত্যের সুবর্ণময় যুগ । বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস সম্ভবত চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । সমকালীন কবি বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী হলেও আদতে বাংলার কবি বলেই স্বীকৃত ছিলেন । বাংলার সুলতানরা রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করান । কৃত্তিবাস রামায়ণ লেখেন । হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করান । পরাগলের পুত্র চট্টগ্রামের শাসক ছুটি খান মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করবার জন্য শ্রীকর নন্দীকে নিযুক্ত করেছিলেন । কাশীরাম দাসও মহাভারত অনুবাদ করেন । বর্ধমানের কবি মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য’ রচনা করে ‘গুণরাজ খান' উপাধি লাভ করেন । তিনি ভাগবতেরও বঙ্গানুবাদ করেন । বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক বৃহস্পতি মিশ্রও এই যুগে আর্বিভূত হন । হুসেন শাহের আমলে বিপ্রদাস পিপলাই ও বিজয় গুপ্ত ‘মঙ্গল কাব্য’ রচনা করেন । মানিক দত্তের ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও শঙ্করকিঙ্কর মিশ্রের ‘গৌরীমঙ্গল’ এই সময় রচিত হয়েছিল । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যকে কেন্দ্র করে যে জীবনী সাহিত্য রচনা হয়েছিল, তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটা গর্বের বিষয় । চৈতন্য জীবনীকারদের মধ্যে বৃন্দাবন দাস, গোবিন্দ দাস এবং জ্ঞানদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজের নাম উল্লেখযোগ্য । এই সময়ের আর একজন বিখ্যাত কবি হলেন মুকুন্দ দাস ।
(২) হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য (Hindi Languages and Literature) : হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের জনপ্রিয়তার জন্য সুফি-সন্তদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় । তাঁরা হিন্দি ভাষাতেই শ্রোতাদের সম্ভাষণ করতেন । পরে কবির, সুরদাসও মীরার ভজন লিখে হিন্দি সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করে গেছেন । আমির খসরুও হিন্দিতে তাঁর সাহিত্য কীর্তি রেখে গেছেন । জৌনপুরের বিখ্যাত সুফি সাধক মহম্মদ জয়সিও হিন্দি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন । তাঁর লেখা ‘পদ্মাবতী’ বিখ্যাত । দাদু ও গুরু নানকও কবিতা লিখতেন । তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ হিন্দি সাহিত্যের অমর সম্পদ ।
(৩) অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্য (Other Languages and Literature) : মারাঠি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে নামদেবের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । নানক ও তাঁর শিষ্যরা গুরুমুখি ভাষার উন্নতির জন্য সর্বদা উৎসাহ দেখাতেন । পশ্চিম ভারতে জৈন সাধকগণ প্রাচীন গুজরাটি ভাষাতে লেখা সমস্ত জৈনশাস্ত্র সংগ্রহ করে গুজরাটি ভাষার প্রতি অপরিসীম ভালবাসার নিদর্শন রাখেন । আসামের ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা শঙ্করদেব অহমিহা ভাষাকে জনপ্রিয় করে তোলেন । তিনি পুরাণের কাহিনি অবলম্বনে কয়েকটি একাঙ্ক নাটক রচনা করেন । পুরীতে থাকাকালীন শ্রীচৈতন্য তাঁর শিষ্যদের সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে ঊড়িয়া ভাষা ব্যবহারে উৎসাহ দিতেন । বিহারে মৈথিলি ভাষার উন্নতির পিছনে ভক্তিবাদ ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ছিল অনেকখানি ।
মুঘল যুগেও আঞ্চলিক সাহিত্যের উন্নতি অব্যাহত ছিল । এই সময় মারাঠি ভাষায় একনাথ, রামদাস ও তুকারাম, অহমিয়া সাহিত্যে মাধবদেব, গুজরাটি সাহিত্যে শ্রীধর, নরসিংহ মেহতা, আখো ইত্যাদি, ওড়িয়া সাহিত্যে উপেন্দ্র ভঞ্জ, কবিসুর্য বলদেব প্রভৃতি সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছিলেন । দক্ষিণ ভারতে তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও মালায়ালাম সাহিত্য সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল । চোল ও পাণ্ড্যদের পতনের পর অবশ্য তামিল সাহিত্যের গৌরবময় যুগের অবসান হয়েছিল । বিজয়নগর রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় কন্নড়ি ভাষার প্রভূত উন্নতিসাধন হয়েছিল । বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমল ছিল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ । দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।
*****
- 4479 views